উদ্যোক্তাদের ঠিকানা 'মোড়'

‘মোড়’–এর দুই উদ্যোক্তা। নাবিলা নওরিন ও নাহিদ শারমিন। ছবি: সাইফুল ইসলাম
‘মোড়’–এর দুই উদ্যোক্তা। নাবিলা নওরিন ও নাহিদ শারমিন। ছবি: সাইফুল ইসলাম

মফস্বলের পাড়া–মহল্লার মোড়ে মোড়ে তরুণেরা আড্ডা দেন। সেই আড্ডা থেকেই অনেক সময় বেরিয়ে আসে দারুণ কিছু। সেই ধারণা থেকেই ‘মোড়’। কোওয়ার্কিং স্পেস। যেখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধার অফিস ভাগাভাগি করে ব্যবহারের সুযোগ পান উদ্যোক্তারা। ব্যবসায়িক কিংবা দাপ্তরিক বৈঠক করার মতো সুবিধা তো আছেই। 

বনানী ১১ নম্বর সড়কে ‘মোড়ের’ কার্যালয়ে ঢুকলেই চোখে পড়বে একটি ল্যাম্পপোস্ট। কালো রঙের ল্যাম্পপোস্টটি মনে করিয়ে দেবে সেই মফস্বলের কথা। মোড়ের চত্বরজুড়ে আধুনিকতার ছাপ। ছিমছাম পরিবেশে বিভিন্ন টেবিলে বসে কম্পিউটারে কাজ করছেন জনা বিশেক তরুণ-তরুণী। পথের পাঁচালি, ঘরে, বাইরে, ঘরে-বাইরে নামের চারটি বৈঠকস্থলও সমান ব্যস্ত। 

মোড়ের গল্প শুনতে গত জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহের এক দুপুরে দুই উদ্যোক্তা—নাবিলা নওরিন ও নাহিদ শারমিনের সঙ্গে আড্ডা হয়। তাঁরা জানান, বনানী ১১ নম্বরে সড়কে ২০১৫ সালে ৫ মে মোড়ের যাত্রা শুরু হয়। এক দফা স্থান পরিবর্তনের পর বর্তমানে ২ হাজার বর্গফুট আয়তন জায়গা নিয়ে মোড় চলছে। গত মার্চ মাসে ধানমন্ডিতে মোড়ের নতুন আরেকটি শাখা চালু হয়েছে। 

শুরুর গল্পটা বললেন নাবিলা নওরিন। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যবিদ্যায় পড়াশোনা শেষ করে ২০১২ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোয় যান তিনি। সেখান থেকে আবার ইন্টার্নি করতে যান ব্রাজিলের সাও পাওলো শহরে। সেখানকার তরুণ উদ্যোক্তারা কোওয়ার্কিং স্পেসে ভাগাভাগি করে নিজেদের কাজ করেন। বিষয়টি মনে গেঁথে যায় নাবিলার। ২০১৪ সালে দেশে ফেরার আগেই বান্ধবী নাহিদ শারমিনের সঙ্গে সে রকম কিছু একটা করার জন্য চিন্তাভাবনা শুরু করেন। 

বাংলাদেশে অনেক তরুণ উদ্যোক্তা ফ্রিল্যান্স, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ওয়েব ডেভেলপমেন্টসহ নানা ধরনের কাজ করেন। তাঁদের পক্ষে কাজের জন্য কিংবা ব্যবসায়িক অংশীদারদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য নিজস্ব অফিস স্থাপন করাটা বেশ ব্যয়বহুল। তা ছাড়া অফিসের পেছনে প্রতি মাসেই মোটা অঙ্কের অর্থ খরচের বিষয় তো আছেই। সেই বাড়তি ব৵য় বোঝা থেকে মুক্তি দিতেই ‘মোড়’ শুরু। 

এমন তথ্য দিয়ে নাবিলা নওরিন বলেন, ‘শুরুতে ধারণাটি তরুণদের কাছে জনপ্রিয় করাটা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। মোড়ের প্রথম দিকে অনেকেই উঁকি দিতেন। জানতে চাইতেন—এটি কি রেস্তোরাঁ, নাকি বাতির (লাইট) দোকান? আমরা সবাইকে খুব আগ্রহ নিয়ে মোড় ঘুরিয়ে দেখাতাম। আমাদের ধারণাটি তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করতাম।’ 

ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে মোড়। বনানীতে এখন বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে মোড়ের সদস্যসংখ্যা ১২০। তাঁদের মধ্যে আছেন বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি ও তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন এমন উদ্যোক্তারা। গুলশানের এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের পর একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা তিন মাস মোড়ে তাঁদের দাপ্তরিক কাজ করেন। অন্যদিকে সুইস একটি সফটওয়্যার কোম্পানি ধানমন্ডি মোড় আগামী পাঁচ বছর ব্যবহারের জন্য চুক্তি করেছে। সেই প্রতিষ্ঠানের ৩৪ জন কর্মী কাজ করছেন। তারা মোড়ের অর্ধেক অংশ ব্যবহার করে, বাকিটা ব্যবহার করছে অন্য উদ্যোক্তারা।

সদস্য না হলেও প্রতি ঘণ্টা ১৫০ টাকায় মোড়ের সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করা যাবে। মাসে ২ হাজার টাকা দিয়ে হওয়া যাবে ‘স্টার্টার’ সদস্য। তখন মোড়ের দুই শাখার একটিতে ৪০ ঘণ্টা ব্যবহার করতে পারবেন উদ্যোক্তারা। আবার ৮ হাজার টাকা দিয়ে ‘ইনফিনিটি’ সদস্য হলে ইচ্ছামাফিক যত ঘণ্টা খুশি মোড়ে অফিস করা যাবে। সদস্যদের জন্য আছে খাবারের কক্ষ ও কফির সুবিধা। 

মোড়ের সদস্য ইসমাইল সাঈদ নিজে একটি মেডিকেল সফটওয়্যার বানাচ্ছেন। তিনি বললেন, ‘২ লাখ টাকা খরচ করে হাতিরপুলে অফিস নিয়েছিলাম। তারপর খরচ জোগাতে না পেরে ছেড়ে দিয়েছি। বর্তমানে বেশ স্বচ্ছন্দে মোড়ে অফিস করছি।’ তিনি বলেন, মোড়ে আসার পর কাজ না করে উপায় নেই। কারণ প্রতি মিনিটের জন্য আপনি পয়সা গুনছেন। আবার আপনি যখন দেখবেন আপনার আশপাশে সবাই কাজ করছেন তখন আপনিও উদ্বুদ্ধ হবেন। তা ছাড়া এখানে কাজ করতে গিয়ে সবার মধ্যে একটা নেটওয়ার্ক তৈরি হয়। তখন কাজ পেতেও সুবিধা হয়। 

মোড় পরিচালনা করতে করতে আড়াই বছর আগে ‘বহু’ নামে আসবাবের একটি ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন নাবিলা নওরিন ও নাহিদ শারমিন। বনানীতে ‘বহু’র একটি বিক্রয়কেন্দ্র আছে। তার বাইরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য স্থাপত্যচর্চা, অন্দরসজ্জা ও আসবাবের নকশা করেন তাঁরা। 

গত মাসে রাইজিং স্টার অব দ্য ইয়ার ক্যাটাগরিতে নারীদের জন্য সিটি ব্যাংকের বিশেষায়িত সেবা সিটি আলোর সহায়তায় কালারস প্লাটিনাম বিজনেস উইমেন অ্যাওয়ার্ড-২০১৯ পেয়েছেন নাবিলা নওরিন ও নাহিদ শারমিন।