ব্যাগভর্তি টাকায় পকেটভর্তি বাজার করার গল্প

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অতি মূল্যস্ফীতি দেখা দিলে জার্মানির শিশুরা এভাবেই ডয়েসে মার্ক দিয়ে খেলত
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অতি মূল্যস্ফীতি দেখা দিলে জার্মানির শিশুরা এভাবেই ডয়েসে মার্ক দিয়ে খেলত

তাত্ত্বিকভাবে মূল্যস্তর অব্যাহত বেড়ে যাওয়াই মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির উৎপত্তি বিষয়ে দুটি তত্ত্ব রয়েছে। একটি হচ্ছে অর্থের পরিমাণ তত্ত্ব এবং অন্যটি বাড়তি চাহিদা তত্ত্ব। অর্থের পরিমাণ তত্ত্ব হচ্ছে অর্থের পরিমাণ বা সরবরাহ বৃদ্ধি। এর ফলে যে মূল্যস্ফীতি ঘটে, তাকে মুদ্রাস্ফীতিও বলা যায়। বাড়তি চাহিদা তত্ত্ব হচ্ছে কোনো অর্থনীতিতে চলতি মূল্যস্তর ও সেবাগুলোর সামগ্রিক চাহিদা বেশি হলে মূল্যস্তর বাড়ে। কারণ হিসেবেও মূল্যস্ফীতি দুই ধরনের। যেমন চাহিদা বৃদ্ধিজনিত বা ডিমান্ড পুল ও ব্যয় বৃদ্ধিজনিত বা কস্ট পুশ। অর্থাৎ অর্থনীতিতে চাহিদা বাড়লে এবং সরবরাহ কম থাকলে যে মূল্যস্ফীতি ঘটে, তাকে চাহিদা বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতি বলা হয়। আবার উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতি হলে সেটা হলো ব্যয় বৃদ্ধিজনিত। এভাবেও বলা যায়, চাহিদার টান ও ব্যয়ের ঠেলা।

মূল্যস্ফীতিকে বলা হয় অর্থনীতির নীরব ঘাতক। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষকে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয়, সেই অর্থকে বলা হয় একধরনের বাধ্যতামূলক কর। এতে ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়, বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষের। হিসাবটা পরিষ্কার। আগে যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা ব্যয় করতে হতো, মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশ হলে সেই একই পণ্য কিনতে হবে ১১০ টাকায়। কিন্তু ওই বাড়তি ১০ টাকা আয় না বাড়লে কী হবে? ১০ টাকার পণ্য কম কিনতে হবে। মূল্যস্ফীতিতে এমনটাই ঘটে। প্রকৃত আয় কমে, ভোগও কমে যায়।

তৃতীয় শতাব্দীতে রোমান সাম্রাজ্যে বড় ধরনের মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছিল। ইতিহাস বলে, সেটাই বিশ্বে প্রথম মূল্যস্ফীতির ঘটনা। মুদ্রার বদলে পেপার নোট চালু করার পর চীনে বড় ধরনের মূল্যস্ফীতি ঘটে চতুর্দশ শতাব্দীতে। আর ইউরোপসহ অন্যত্র উচ্চ মূল্যস্ফীতির অভিজ্ঞতা ষোড়শ শতাব্দীতে। মার্কিন ও ফরাসি বিপ্লবের সময় প্রচুর মুদ্রা ধ্বংস করা হয়েছিল। এরও পরিণতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি।

মূল্যস্ফীতির দিক থেকে ভালো ছিল উনিশ শতকটি। মূল্যস্ফীতি তো ছিলই না, বরং ছিল ডিফ্লেশন। নেপোলিয়নের যুদ্ধের সেই ১৮১৫ সাল থেকে ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি তেমন ছিল না বললেই চলে। উনিশ শতকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দেয় কেবল যুক্তরাষ্ট্রে, গৃহযুদ্ধের কারণে। যুদ্ধের পর পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। মূল্যস্ফীতির শতক হচ্ছে বিংশ শতাব্দী। এই শতকে মানুষ জীবনযাপনের মান যেমন বেড়েছে, নিকৃষ্টতম মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের ভোগান্তিও বেড়েছে।

রাজনীতিকে সবচেয়ে প্রভাবিত করা অর্থনীতির সূচক, মূল্যস্ফীতি। ২০০৫ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গবেষণা বলছে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ১০০টি দেশের ১৯৬০ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সময়ে উপাত্ত পর্যালোচনা করে আইএমএফ বলেছে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা উচ্চ মূল্যস্ফীতি ডেকে নিয়ে আসে। আর যেসব দেশে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বেশি ও গণতন্ত্র আছে, সেসব দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ কম থাকে। আবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ শিল্পোন্নত দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল দেশে বেশি প্রভাব ফেলে।

রুডিগার ডরনবুশ জার্মানির একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ। তিনি একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, বিশ্বব্যাপী সরকারগুলোর শাসনামলে অর্থনৈতিক বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরাই মন্ত্রিসভার রদবদলের শিকার হন সবচেয়ে বেশি এবং তাদের মন্ত্রিত্বের মেয়াদকালের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হারের নেতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে।

কিছুটা মূল্যস্ফীতি থাকা কিন্তু ভালো। কারণ, এতে উৎপাদন বাড়ে, উৎপাদকেরা উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহী হন।

কত শতাংশ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি থাকা ভালো, তা নিয়ে যদিও মতভেদ আছে। আইএমএফ মনে করে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাধারণত মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেলে সেটাই বিপজ্জনক। কেননা তা প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দেয় এবং দরিদ্রদের ক্ষতিগ্রস্ত করে।

সর্বশেষে মূল্যস্ফীতি নিয়ে পুরোনো দুটি গল্প বলি। একটা সময় ছিল যখন মানুষ পকেটভর্তি টাকা নিয়ে বাজারে যেত আর ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে যেত বাসায়। এখন কিন্তু মানুষ ব্যাগভর্তি টাকা নিয়ে বাজারে যায় আর পকেটভর্তি বাজার নিয়ে বাসায় ফেরে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গল্পটি এ রকম—প্রশ্ন: রুবল, ডলার ও পাউন্ডের পারস্পরিক বিনিময় হার কত? উত্তর: এক পাউন্ড রুবল=এক ডলার।

সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি কত হতে পারে, মিলিয়ে দেখুন

দেশ                             বিনিময় মূল্য

১. ভেনেজুয়েলা              ২৮২,৯৭২.৮০% (এপ্রিল ২০১৯)

২. জিম্বাবুয়ে                  ১৭৫.৬৬% (মার্চ ২০১৯)

৩. দক্ষিণ সুদান             ৫৬.১০% (মার্চ ২০১৯)

৫. ইরান                       ৫০.৪০% (জুন ২০১৯)

৬. সুদান                      ৪৭.৮০% (জুন ২০১৯)

৭. লাইবেরিয়া                ২৩.৩০% (এপ্রিল ২০১৯)

৮. হাইতি                      ১৭.৪৬% (মে ২০১৯)

৯. সিয়েরা িলওন         ১৭.৪৬% (মার্চ ২০১৯)

১০. অ্যাঙ্গোলা               ১৬.৯৪% (জুন ২০১৯)

সূত্র: ট্রেডিং একাডেমি