ডিম, আপেলকে ছুঁয়ে বাড়ল পেঁয়াজের ঝাঁজ

পেঁয়াজ খাবেন, নাকি আপেল? পেঁয়াজ দিয়ে ডিম ভাজা খাবেন, নাকি ডিম দিয়ে পেঁয়াজ ভাজা? এমন প্রশ্ন কলেজশিক্ষক মনিরউদ্দিন আহমেদের।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গতকাল রোববার মনিরউদ্দিন পেঁয়াজ কিনতে এসেছিলেন। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, দামের দিক থেকে ওই তিনটি পণ্য এখন একই কাতারে।

বাজার ঘুরে এই কলেজশিক্ষকের মন্তব্যের সত্যতা পাওয়া গেল। দেখা যায়, বড় আকারের একটি পেঁয়াজের দাম এখন ১০ টাকার মতো। একটি আপেলের দামও তাই। একটা ডিমের দাম ১০ টাকা। ভারতীয় পেঁয়াজের কেজি ১০০-১১০ টাকা।

নেপথ্য কাহিনি তাহলে কী? এক মাস আগে ভারত যখন পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিল, দেশের ব্যবসায়ীরা রাতারাতি পেঁয়াজের কেজি ৩০ টাকা বাড়িয়ে ৯০ টাকার ওপর নিয়ে গেলেন। ভারত রপ্তানি বন্ধ করার পর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দীন আশ্বাস দিয়েছিলেন, পেঁয়াজের দাম কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টোটা। দাম আরও বেড়েছে।

ভারতের রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার পর ব্যবসায়ীদের পরের অজুহাত হচ্ছে বৃষ্টি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণে তা এসেছে। একশ্রেণির ব্যবসায়ীর অতি মুনাফালোভী প্রবণতাই পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী বলে মনে করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণে আরও এসেছে, পেঁয়াজের দাম বাড়াচ্ছেন মূলত ঢাকার শ্যামবাজার ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরা, যার প্রভাব পড়ছে খুচরা বাজারে। অর্থাৎ দুটি বাজারের কিছু ব্যবসায়ীর কারণে প্রতিদিন বাড়তি দাম দিয়ে পেঁয়াজ কিনে খেতে হচ্ছে সারা দেশের মানুষকে।

এদিকে মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিতে সরকারি বিক্রয়কারী সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ট্রাকে করে পেঁয়াজ বিক্রি করছে। তবে চাহিদার তুলনায় তা কম। গতকাল সচিবালয়ের সামনে টিসিবির ডিলার ফজলুল হকের কাছে লাইনে দাঁড়ানো পেঁয়াজপ্রার্থীরা টাকা হাতে নিয়ে চিৎকার করছিলেন। ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ১ হাজার কেজি পেঁয়াজের বেশি তিনি পান না। তাই দুপুর ১২টা থেকে বেলা ১টার মধ্যেই তা শেষ হয়ে যায়।

>

দেশি পেঁয়াজের দাম ১১৫-১২০ টাকা কেজি
বড় আকারের একটি পেঁয়াজের দাম ১০-১২ টাকা
একটি আপেলের দামও তা-ই
একটা ডিমের দাম ১০ টাকা

টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত ২৭ সেপ্টেম্বর বাজারে পেঁয়াজের দাম ছিল ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা কেজি। ভারত রপ্তানি বন্ধ করে ২৯ সেপ্টেম্বর। এই খবরে এক লাফে পরদিনই দাম ওঠে ৯০ থেকে ৯৫ টাকা কেজি। এই দামে কয়েক দিন চলার পর এক সপ্তাহের জন্য কমে ৭০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত নেমেছিল। ১৫ দিন ধরে আবার তা শত টাকায় ওঠে।

অথচ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছেই তথ্য রয়েছে, এক মাস ধরে আমদানি করা যে পেঁয়াজ বাজারে বিক্রি হয়েছে, তার কোনোটির দামই ৫০ টাকা কেজির বেশি নয়।

গতকাল চট্টগ্রামের আউটার স্টেডিয়ামে মেট্রোপলিটন চেম্বারের রপ্তানি মেলা উদ্বোধন শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘কষ্টটা বোধ হয় আমাদের আরও একটা মাস করতে হবে। কারণ, আমাদের নিজেদের (পেঁয়াজ) নেই। এবার আমাদের শিক্ষা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে মিসর থেকে চালান এসে পৌঁছালেই দাম সহনীয় হবে।’

শ্যামবাজার ও খাতুনগঞ্জে কী হচ্ছে
ঢাকায় পেঁয়াজের বড় পাইকারি বাজার শ্যামবাজার ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ। দেশির পাশাপাশি মিসর, ভারত, তুরস্ক ও চীন থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ বেচাকেনা হয় এই দুই বাজারে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, উভয় বাজারেই সিন্ডিকেট রয়েছে।

গতকাল এই দুই বাজারেই মিসর থেকে আসা পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৯০ থেকে ৯৫ টাকা কেজি, যা দুই দিন আগেও ছিল ৮০ থেকে ৯০ টাকা। দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা।

বাজার তদারকি নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী গতকাল চট্টগ্রামে বলেন, হঠাৎ করে চাপ দিলে ব্যবসায়ীরা বিগড়ে যান। এতে মানুষের কষ্ট আরও বাড়ে।

তবে বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দীন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘শ্যামবাজার ও খাতুনগঞ্জে বাড়তি নজরদারি করছি। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সাধারণ অভিযানের পাশাপাশি আজ (রোববার) বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকেও শ্যামবাজারে দুটি দল পাঠানো হয়েছে।’

শ্যামবাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, কয়েকটি হাত ঘুরে তাঁদের কাছে পেঁয়াজ আসে এবং তাঁরা বেশি মুনাফা করছেন না। আর খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদরিস বলেন, তাঁরা কমিশনের ভিত্তিতে ব্যবসা করেন এবং অতি মুনাফার প্রবণতা তাঁদের নেই।

কারওয়ান বাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী আবদুল মোমেন প্রথম আলোকে বলেন, বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে বলে বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। কিন্তু পেঁয়াজ কিনতে আসা নুরুল ইসলাম মুখের ওপর প্রতিবাদ করে বলেন, ‘মিথ্যে কথা। কেজিতে পারলে তারা প্রতিদিন ১০ টাকা করে বাড়ায়। শ্যামবাজার ও খাতুনগঞ্জে অভিযান চালালেই দাম কমে আসবে।’

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম]