থোক বরাদ্দের ব্যয় সুনির্দিষ্ট করতে হবে
>করোনাভাইরাসের কারণে দেশের স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থা ও দুর্বলতা এখন প্রকট। অথচ নতুন বাজেটে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আছে গতানুগতিক কিছু প্রস্তাব, কিছু বরাদ্দ বৃদ্ধি। সংকট উত্তরণে তা যথেষ্ট বলে মনে করেন না বিশেষজ্ঞরা। তাহলে কী করতে হবে? সুনির্দিষ্ট কিছু পরামর্শ দিলেন হোসেন জিল্লুর রহমান।

বাজেটের আগে বলেছিলাম যে এর সাহিত্যটা আমি জানতে চাই। সেই সাহিত্যটা আসলে অজানাই থেকে গেল। সাহিত্য বলতে আমি বুঝিয়েছিলাম, উপলব্ধিজাত সার্বিক বিশ্লেষণের বিষয়টিকে। কিন্তু সেই বিশ্লেষণ কোথায়? বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতাগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করাটা দরকার ছিল। কিন্তু সেই মূল্যায়ন দেখিনি। কোন কোন জায়গায় আমরা আটকে গেছি, তার কোনো চিত্র নেই। আটকে যে গেছি সেটা কিন্তু এখন পরিষ্কার। করোনা একটা ঘটনা ঘটেছে—বাজেটে শুধু এই স্বীকৃতিটুকুই আছে। স্বাস্থ্য যে একটা খাত শুধু নয়, এটি যে একটা কৌশলগত বিষয় ওই উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ বাজেট বক্তৃতায় দেখিনি। কিন্তু এর খুব প্রয়োজন ছিল। বাজেট বক্তৃতায় সাধারণ একটি বক্তব্য এসেছে যে কোভিড-১৯ একটা ধাক্কা দিয়েছে। শুধু এতটুকুই। স্বাস্থ্যসেবা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছে, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। আর ভবিষ্যতে এটা কোথায় দাঁড়াবে, তা আমরা বুঝতে পারছি না। কিন্তু এ নিয়ে কোনো অন্বেষণ নেই, বিশ্লেষণ নেই, বিশ্লেষণের দিকে মনোযোগও নেই। মনোযোগের অভাব এবং দক্ষতারও অভাব। সংবাদপত্রে যেটাকে বলে সাদামাটা প্রতিবেদন, বাজেটে তেমন একধরনের বিষয় পেলাম। শুধু একটি লাইনে স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতাগুলোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়টি সেখানে খুব জোরালোভাবে উঠে আসা উচিত ছিল। কেননা বরাদ্দ এবং এর সদ্ব্যবহার নির্ভর করছে স্বাস্থ্য বিভাগের আমূল সংস্কারের ওপর। সংস্কার দরকার কয়েকটি কারণে। এ দপ্তরের কাজের অদক্ষতা, দুর্নীতি ও অপচয় আলোচিত বিষয়। কাগুজে পরিকল্পনার মধ্যেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আটকে আছে। নানা ধরনের সভা হচ্ছে, কমিটি তৈরি হচ্ছে। কিন্তু পুরো বিষয়টির মধ্যে একটি কাগুজে প্রচেষ্টা। সেটা এই কোভিডের সময় আরও মূর্ত হয়ে উঠল।
প্রস্তাবিত বাজেটে ১০০ কোটি টাকার গবেষণার বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। এটা ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু এখন আস্থার যে বড় ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে, সেখানে গবেষণা কীভাবে পরিচালিত হবে, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। স্বাস্থ্যনীতি, স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালনার যে গতি সেখানে গবেষণার বিষয়টি গৌণ হয়ে আছে। মূলত আমলাদেরই প্রবল প্রতাপ বহাল সেখানে। তাই বরাদ্দ টাকা কীভাবে ব্যবহৃত হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ডা. জাফরুল্লাহরা দেশীয় গবেষণার মাধ্যমে একটি কিট উদ্ভাবন করলেন। কিন্তু এর প্রতি যে মনোভাব দেখলাম, তাতে দেশীয় গবেষণার প্রতি মনোভাব কেমন হবে, সেই শঙ্কা থেকেই যায়। সার্থক ও কার্যকর গবেষণার প্রতি কতটুকু মনোযোগ আছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
স্বাস্থ্য খাতে একটা বড় বৈষম্য দেখতে পাচ্ছি। এখন এই করোনাকালে অতি ধনী এবং ক্ষমতাবলয়ের কাছাকাছি যারা আছে তারা সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানগুলোতে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। আবার এই সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানও গুনতে গুনতে এক-দুইয়ে চলে এসেছে। ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ, মৃত্যুর হার কোনোটাই কমছে না।
এবার আসি বরাদ্দের বিষয়ে। আগে ২৫ হাজার কোটি টাকার মতো ছিল। এবার তা ২৯ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে। কিন্তু বাড়তি এ টাকার মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আসছে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রকল্প থেকে। এ দুটো প্রকল্প ব্যয় বাদ দিলে দেখা যাবে, বেড়েছে আসলে ১ হাজার ২২ কোটি টাকা। এখানে বুঝতে পারছি বরাদ্দের কী অবস্থা।
এবার করোনার জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। থোক বরাদ্দ সাধারণত জরুরি কাজের জন্য বা যে বিষয়টি জানা নেই, বা প্রয়োজন হতে পারে এমন খাতে দেওয়া হয়। করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর সরকার কি এখনো বুঝতে পারেনি কী করতে হবে বা না হবে? যাহোক, যে অর্থ দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে একটি অবশ্যকরণীয় কাজ হবে এর ব্যয়ের দিক সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে এটা দিতে হবে। কারণ, থোক বরাদ্দ থেকে দুর্নীতি ও অপচয়ের একটা প্রবণতা দেখা দেয়। পুরোটা না হলেও সাত থেকে আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের খাতওয়ারি বিন্যাস করে দিতে হবে। এমন সুনির্দিষ্ট কিছু খাতের কথা আমি বলতেও পারি।
থোক বরাদ্দের অর্থ সংক্রমণ যেখানে বেশি অর্থাৎ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সিলেটের মতো অঞ্চলে সুযোগ বাড়ানোর কাজে লাগানো জরুরি। প্রয়োজনে বেসরকারি হাসপাতালে রিকুইজিশন করতে হবে। ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকা একাধিক প্রতিষ্ঠান নিজেরা হাসপাতাল নিয়ে ফেলেছে। এখন সরকারকে সবার জন্য এই পরিষেবা বাড়াতে হবে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সব উপজেলায় আছে। কিন্তু সদর উপজেলা স্তরে হাসপাতাল নেই। এই মুহূর্তে ক্রাশ কর্মসূচির মাধ্যমে ৬৪টি সদর উপজেলায় একটি করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স করা যেতে পারে। এটা ১০ হাজার কোটির ব্যবহারের সুস্পষ্ট জায়গা।
বরাদ্দের আরেক জায়গা হতে পারে নগর অঞ্চলের প্রাথমিক স্বাস্থ্য। বিশেষ করে বস্তি এলাকা বা নিম্ন আয়ের মানুষের আধিক্য যেখানে সেখানে এ পরিষেবা দিতে হবে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট বা খুলনার মতো শহরে ওয়ার্ডভিত্তিক স্বাস্থ্য পরিকাঠামো দরকার।
এখন হাত ধোয়া নিয়ে অনেক কথা বলা হচ্ছে। এ জন্য পানি তো লাগবে। গণশৌচাগার ও হাত ধোয়ার ক্ষেত্রে এখন বড় বিনিয়োগ হতে পারে। কমিউনিটিভিত্তিক, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের এলাকায় এটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হতে পারে।
পরিচ্ছন্নতা নিয়ে দেশের ৩২৯টি পৌরসভার ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রস্তাবও আছে। তাদের জন্য এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিলে তাতে ক্ষতি কিছু হবে না।
হাইজিন বা স্বাস্থ্যবিধির পুরো বিষয়টির জন্য সচেতনতামূলক প্রচার একটি বড় বিষয়। গত শতকের ৮০ ও ৯০-এর দশকে জন্মনিয়ন্ত্রণ, প্রাথমিক শিক্ষা, নারীশিক্ষা, টিকাদান, স্যানিটেশনে ব্যাপক প্রচার ছিল। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক কিছু অর্জন করেছে সচেতনতা কর্মসূচির মাধ্যমে। এনজিও এবং সামাজিক শক্তিগুলোকে সম্পৃক্ত করেই এই সচেতনতার কাজ হয়েছে। টিকাদান কর্মসূচি সরকারি কর্মসূচি হিসেবে বহুদিন ছিল। কিন্তু এটি গতিশীল ছিল না। কিন্তু এনজিওদের সম্পৃক্ত করার পর এ কাজে গতি আসে। হাইজিনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের একটি সামাজিক প্রচার দরকার। প্রচারের কথা উঠলে বলা হয়, ঠিক আছে আপনারা প্রচার করুন। কিন্তু এর জন্য তো বরাদ্দ লাগবে, বাজেট লাগবে। এটা তো বায়বীয়ভাবে হবে না। হাইজিন একটা বড় অ্যাজেন্ডা হিসেবে আমাদের প্রাধান্যের তালিকায় থাকা উচিত। আর এর পাশাপাশি এনজিও, সামাজিক শক্তি ও তরুণ শক্তিকে একত্র করে একটা বড় কর্মকাণ্ড চালানো উচিত।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় মাতৃমৃত্যুর হার দেখানো হয়েছে ১৬৯। কিন্তু এ উপাত্ত বিতর্কিত। কারণ, সরকারেরই আরেক দপ্তর পরিসংখ্যান দিয়েছে ১৯৬।
করোনার সময় নারীর ও কিশোরীর স্বাস্থ্য উপেক্ষিত হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ ও অনিরাপদ গর্ভপাত বেড়ে যাওয়ার প্রাথমিক তথ্যভিত্তিক আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে। এখন বাজেটে এটি সুস্পষ্টভাবে নারী ও কিশোরীর মনঃসামাজিক সহযোগিতার দরকার আছে।
হোসেন জিল্লুর রহমান, নির্বাহী চেয়ারম্যান, পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)