'দ্বিতীয় মার্ক্স' এলেন কি?

টমাস পিকেটি
টমাস পিকেটি

বয়স তাঁর মাত্র ৪৩ বছর৷ কিন্তু এই বয়সেই দুনিয়াজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন ফেলে দিয়েছেন ৬৬৩ পৃষ্ঠার এই সুবিশাল বই লিখে৷ বইয়ের নাম ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি৷ বাংলায় বলা যায় একুশ শতকে পঁুজি৷ লেখক টমাস পিকেটি৷ ফরাসি অর্থনীতিবিদ৷ জন্মেছেন ফ্রান্সে, ১৯৭১ সালে। ফরাসি ভাষাতেই প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। আর চলতি বছরের মার্চে বের হয় ইংরেজি সংস্করণ৷ তার পরই যেন হুলুস্থুল৷ ‘বেস্ট সেলার’ বা ‘সর্বাধিক বিক্রীত’ বইয়ের ছাপ লেগে গেছে ইতিমধ্যে৷ মুদ্রিত ইংরেজি সংস্করণ ইতিমধ্যে ৮০ হাজার বিক্রি হয়ে গেছে৷ ডিজিটাল রূপে হয়েছে ১৫ হাজার৷ আর ফরাসি মুদ্রিত সংস্করণ ৫০ হাজার৷
বইটির মূল প্রতিপাদ্য আয় ও সম্পদের বৈষম্য৷ ধনী আরও ধনী, গরিব আরও গরিব হচ্ছে- এই ‘সমাজতান্ত্রিক’ ধারণাটিকে িপকেটি যেন নতুন তবে বিরাট এক ভিত্তি দিলেন এই বইয়ে৷ বললেন, সম্পদ বণ্টনের নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে৷ এ জন্য দুনিয়াজুড়ে বসাতে হবে সম্পদ কর৷ আর তাই বিশ্বখ্যাত দ্য ইকোনমিস্ট সাময়িকী তাঁকে ‘আধুনিক মার্ক্সস’ (কার্ল মার্ক্স) হিসেবে অভিহিত করেছে। সমালোচকেরা কেউ কেউ একটু কটাক্ষের ছলেও বলছেন যে ‘দ্বিতীয় মার্কস’ এলেন বুঝি!
টমাস পিকেটি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গবেষণার পর বইটি লিখেছেন। ফ্রান্সের আয়কর বিষয় তথ্য-উপাত্তগুলো অনেক বিস্তারিতভাবে যুগের পর যুগ ধরে সংরক্ষণ করা হয়েছে৷ তিনি প্রথমে সেদিকেই মনোযোগ দিয়েছেন৷ আয়করের তথ্য বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে চিহ্নিত করেছেন কীভাবে সম্পদের পাহাড় জমেছে অল্প কিছু লোকের হাতে৷ আর বাকিরা পিছিয়ে পড়েছে৷ তাঁর গবেষণার পরিধি বিস্তৃত হয়েছে মার্কিন যু্ক্তরাষ্ট্রসহ ৩০টি দেশে৷ তিনি শিল্প-বিপ্লবের শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বৈষম্যের বিবর্তনচিত্র সবিস্তারে তুলে ধরেছেন।

পিকেটি বলেন, অষ্টাদশ ও উনিশ শতকজুড়ে পশ্চিম ইউরোপীয় সমাজ ছিল একেবারে বৈষম্যে পূর্ণ। সেই সময়ে ব্যক্তিগত ধনসম্পদের বিকাশ গড় জাতীয় আয়কে ছাড়িয়ে যেতে থাকে। এতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে পড়ে মুষ্টিমেয় সংখ্যক পরিবারের হাতে, যারা সমাজে উচ্চবিত্ত বা নাক-উঁচু স্বভাবের একটি শ্রেণী বা কাঠামো তৈরি করে। এই বৈষম্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। এমনকি শিল্পায়নের সুবাদে শ্রমিকদের মজুরি ধীরে ধীরে বাড়লেও বৈষম্য বৃদ্ধির প্রবণতা বজায় থাকে। সম্পদের এই বৈষম্য অবশ্য গত শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৯ ও ১৯৩৯-৪৫ সাল) এবং ত্রিশের দশকের অর্থনৈতিক মহামন্দায় কিছুটা স্তিমিত হয়। কারণ, তখন একদিকে উচ্চহারের কর ও মূল্যস্ফীতির চাপসহ কোম্পানিগুলোর ঋণ পরিশোধের অক্ষমতা বা দেউলিয়াত্ব বেড়ে যায়, অন্যদিকে বিশ্বে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রবণতা বিকশিত হয়। ফলে ধনীদের সম্পদ নাটকীয়ভাবে সংকুচিত হতে থাকে। এর ফলে ওই সময়ে সমানুপাতিক হারে/সমধিকারের ভিত্তিতে আয় ও সম্পদ বিতরণ হয়।
কিন্তু পিকেটি দেখান, বিশ শতকের এই বৈষম্য কমার প্রবণতা ঝিমিয়ে পড়ে, ফুরিয়ে যায়। আয় ও সম্পদের বৈষম্য আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, যা এত দিনে প্রকট আকার ধারণ করেছে। আর আধুনিক অর্থনীতিতে সম্পদের বণ্টন-প্রক্রিয়া আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের অবস্থাতেই ফিরে গেছে।
বৈষম্যের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে পিকেটি অর্থনীতিতে একটি নতুন তত্ত্ব উপস্থাপন করে বলেন, সাধারণ নিয়মে সমাজে সম্পদ যে গতিতে বৃদ্ধি পায়, সেই তুলনায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়ে না। তিনি বলেন, অন্য সবকিছু সমান থাকতে পারে। কিন্তু দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই একটি সমাজে সম্পদের গুরুত্বকে খর্ব করে দিতে পারে। অন্যদিকে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধীর বা শ্লথগতি সম্পদের গুরুত্ব বাড়ায়। কিন্তু প্রকৃতিতে এমন কোনো শক্তি নেই, যা সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণ/ পুঞ্জীভূতকরণ ঠেকাতে পারে। এই অবস্থায় দ্রুত প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি এবং সরকারি হস্তক্ষেপই কেবল অর্থনীতিকে আবার ‘পিতৃতান্ত্রিক সমাজের পুঁজিবাদে’ ফিরে যাওয়ার পথ থেকে ফেরাতে পারে, যা নিয়ে একসময় কার্ল মার্ক্সও উদ্বিগ্ন ছিলেন।

সে জন্য টমাস পিকেটির সুপারিশ হলো, ধনী-গরিবের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান বৈষম্য রোধে সরকারগুলো এখনই সম্পদের ওপর গ্লোবাল ট্যাক্স বা বৈশ্বিক কর আরোপের পদক্ষেপ নিতে পারে। এতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কমবে বলে তিনি মনে করেন।
তবে সমালোচকেরা বলছেন, সম্পদের ওপর বৈশ্বিক কর আরোপের কাজটি হবে সবচেয়ে কঠিন। তা ছাড়া আজকের যুগের ধনীদের অধিকাংশই উত্তরাধিকারসূত্রে নয়, তাঁদের নিজ নিজ প্রচেষ্টায় বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। আবার অন্যদের যুক্তি হলো, পিকেটির সুপারিশ যতটা অর্থনৈতিক, তার চেয়ে অনেক বেশি আদর্শিক। এতে ভালো হওয়ার সম্ভাবনার চেয়ে খারাপ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। কেননা, একালে মার্ক্স তো অচল৷ তবে পিকেটিকে সমর্থনকারীদের পাল্টা যুক্তি, তাহলে দ্বিতীয় মার্ক্সস বলতে হচ্ছে কেন?
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, বার্তা সংস্থা৷