সামনে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের বিশাল সম্ভাবনা

দেশের ওষুধ খাতের অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব ও ইনসেপ্ টা ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মুক্তাদির

আব্দুল মুক্তাদির
আব্দুল মুক্তাদির

প্রথম আলো: বর্তমানে বাংলাদেশের ওষুধের অভ্যন্তরীণ বাজারটি প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার। প্রবৃদ্ধিও ভালো। চলতি বছর শেষে বাজারের আকার ও প্রবৃদ্ধি কেমন হবে?
আব্দুল মুক্তাদির: ২০১৩ সালে দেশজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও ওষুধের অভ্যন্তরীণ বাজারটি ছিল প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ১ শতাংশ। সেই তুলনায় এ বছর রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই। তাই আশা করছি, চলতি বছর শেষে ওষুধের অভ্যন্তরীণ বাজারটির আকার সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এ ছাড়া চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সময়কালের যে হিসাব আমাদের কাছে রয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ওই সময় পর্যন্ত সাড়ে ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ বছর শেষে প্রবৃদ্ধির হার ৯ শতাংশেরও বেশি হতে পারে। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে এ খাতে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা খুব কঠিন হবে না।
প্রথম আলো: ওষুধশিল্প প্রসারের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো কী কী?
আব্দুল মুক্তাদির: শিল্প খাতে বিদ্যুৎ সরবরাহকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেশের যেসব স্থানে গ্যাসের পাইপলাইন বসানো হয়েছে অতি দ্রুততার সঙ্গে সেসব স্থানে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার। এ ছাড়া বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে গ্যাসের চাপ কমে গেছে। তাতে উৎপাদন কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ বিষয়টির আশু সমাধান দরকার। গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করা হলে ওষুধশিল্পের পাশাপাশি পুরো শিল্প খাতে বড় ধরনের বিপ্লব ঘটবে। ঢাকা-চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থার (সড়ক, রেল ও নৌপথ) ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে রেল যোগাযোগের মান বাড়ানোর পাশাপাশি দ্রুত গতি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ জন্য এ খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে হবে সরকারকে।
প্রথম আলো: বিশ্বজুড়ে ওষুধ খাতে গবেষণাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলো গবেষণা খাতে প্রতিবছর গড়ে ১৩৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান কোথায়?
আব্দুল মুক্তাদির: আমাদের সম্পদ ও প্রযুক্তিগত কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এই মুহূর্তে মৌলিক গবেষণায় বিনিয়োগ করার সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। আমরা যেটি করতে পারি সেটি হলো, আবিষ্কৃত ওষুধসংক্রান্ত গবেষণায় গুরুত্ব দিতে। এ মুহূর্তে ওষুধশিল্প খাতে মেধাবী ও কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন একটি বিশাল মানবসম্পদ রয়েছে। কিন্তু সেই সম্পদকে আমরা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারছি না।
প্রথম আলো: সেটিকে কেন কাজে লাগানো যাচ্ছে না?
আব্দুল মুক্তাদির: দীর্ঘদিন ধরে তাগাদা দেওয়ার পরও মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ওষুধশিল্পের জন্য অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রিডিয়েন্ট (এপিআই) পার্ক স্থাপনের কাজটি এখনো শেষ করা হয়নি। ২০১২ সালে এটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে ধাপে ধাপে সময় বাড়ানো হয়েছে। এখন কবে শেষ হবে তাও আমরা নিশ্চিত নই। এই পার্কটি হয়ে গেলে আমার ধারণা, দেশের অনেকগুলো ওষুধ কোম্পানি নিজেদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটাত। প্রতিযোগিতামূলক বাজার ধরতে পণ্য বৈচিত্র্যের পাশাপাশি মান উন্নয়নে অধিক গবেষণা হতো। এতে গড়ে ওঠা দক্ষ মানবসম্পদের যথাযথ ব্যবহার হতো। এ জন্য আমাদের দাবি, যত দ্রুত সম্ভব এপিআই শিল্পপার্ক স্থাপনের কাজটি সম্পন্ন করা হোক।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের ওষুধ খাতের রপ্তানির পরিমাণ এখন কত? রপ্তানি বাজারটি বিস্তৃত হওয়ার আর কোনো সুযোগ আছে কী?
আব্দুল মুক্তাদির: ২০১২ সালে ৪৬৬ কোটি ও ২০১৩ সালে ৫০৬ কোটি টাকার ওষুধ রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। প্রায় ৯০টি দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হয়। বাংলাদেশের সামনে এই বাজারটি বিস্তৃত করার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু আমরা সেটি পারছি না। কারণ, আমাদের ওষুধের মান আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হলেও ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি। এ ছাড়া আমাদের দেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত সরকারি মান যাচাইকারী কোনো ল্যাবরেটরি নেই। এ ধরনের একটি ল্যাবরেটরি স্থাপনের জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু সেই দাবি পূরণ হয়নি। আমি মনে করি, সরকারি ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এবং মান যাচাইকারী ল্যাবরেটরি যদি ডব্লিউএইচওর অনুমোদন পায় তাহলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে এ দেশের ওষুধ খাতের রপ্তানি বাজারটি হবে ২০ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলারের।
প্রথম আলো: দেশের মধ্যেই ওষুধের মান নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। অনেক সময় নিম্নমানের ওষুধ খেয়ে সাধারণের মৃত্যুর খবরও শোনা যায়। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? মানহীন ওষুধের বাজারজাত বন্ধে আপনারা কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না কেন?
আব্দুল মুক্তাদির: ওষুধশিল্প মালিকদের যে সংগঠনটি এবং এ শিল্পের সঙ্গে আমরা যারা জড়িত রয়েছি, তাদের কারও হাতে আইন প্রয়োগের কোনো ক্ষমতা নেই। এই ক্ষমতা আছে একমাত্র সরকারি ওষুধ প্রশাসনের। তাই মানহীন ওষুধের বাজারজাত বন্ধে তাদেরই কাজ করতে হবে। আমাদের কাছে এমন কোনো ক্ষমতা বা ব্যবস্থা নেই, যার মাধ্যমে আমরা মানহীন ওষুধ বাজারজাতকারীদের খুঁজে বের করতে পারি। কিন্তু সরকারের হাতে অনেক দপ্তর রয়েছে যাদের মাধ্যমে এদের খুঁজে বের করা সম্ভব। আমরা যেটি করতে পারি সেটি হলো জনসচেতনতা তৈরি করা। আমরা নানাভাবে সেই কাজটি করে যাচ্ছি।
প্রথম আলো: ওষুধশিল্প খাতে বর্তমানে কত লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে? এটিকে বাড়ানোর কোনো সুযোগ রয়েছে কি?
আব্দুল মুক্তাদির: শিল্প বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এ খাতে কর্মসংস্থানের হারও বাড়ছে। বর্তমানে প্রত্যক্ষভাবে এই শিল্পে লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে। পরোক্ষভাবে এ শিল্পের সঙ্গে আরও পাঁচ লক্ষাধিক লোক জড়িত। এ খাতের ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির বর্তমান ধারাটি অব্যাহত থাকলে আগামী পাঁচ বছরে এ খাতে নতুন করে আরও দুই লাখ লোকের কর্মসংস্থান সম্ভব। আর পরোক্ষভাবে জড়িত শিল্পের হিসাব ধরা হলে এটি ১৫ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
(সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সুজয় মহাজন)