টাকাকে অতিমূল্যায়িত রাখা ঠিক হবে না

>
আহসান এইচ মনসুর
আহসান এইচ মনসুর
জ্বালানি তেলের অব্যাহত দরপতন, পুঁজিবাজার ধস ও চীনের অর্থনৈতিক গতিমন্দা—সব মিলিয়ে একটা মন্দা সময় পার করছে বিশ্ব অর্থনীতি। এ মন্দা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ে সরকার কী সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এসব বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক কর্মকর্তা আহসান এইচ মনসুর

প্রথম আলো: আবার একটা ‘ব্ল্যাক মানডে’ দেখল বিশ্ব অর্থনীতি? কেন এমনটি হলো?

আহসান এইচ মনসুর: অর্থনীতির বিশালত্ব চিন্তা করলে চীনের আর্থিক খাত বেশ দুর্বল। দেশটির পুঁজিবাজারে একটি বিশাল ফাঁক আছে। গত সাত মাসে দেশটির পুঁজিবাজারে ১০০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যেটাকে ‘বাবল বার্স্ট’ বলব আমি। সেটি এখন সংশোধন হয়ে আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। দেশটির বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ীরা গত কয়েক দিনে বিলিয়ন ডলার হারিয়েছেন, আবার মধ্যম আয়ের লোকদের যে স্বপ্ন ছিল, এখন তা পূরণ হবে না। এটার একটা প্রভাব পড়েছে চীনসহ সারা বিশ্বের পুঁজিবাজারে। অন্য দেশে কী হবে, সে প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবে এখানে এসে যায়। কারণ, চীন হচ্ছে বিশ্বে উৎপাদনে এক নম্বর। উৎপাদনের জন্য সারা বিশ্ব থেকে দেশটি কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য সংগ্রহ করে। এটার প্রভাব গিয়ে পড়ছে কয়লা, লোহা, ইস্পাত, তামাসহ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় সব মৌলিক পণ্যের দামে। তাই কমোডিটি মার্কেট এখন সর্বনিম্ন। একই সঙ্গে চীন জ্বালানি তেলের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক। ‘শেল অয়েল’ পাওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন আর আগের মতো আমদানি করছে না। চীনের আগের কেনা জ্বালানি তেল, কয়লা ও লোহার বিশাল মজুত রয়ে গেছে। ফলে অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো মৌলিক পণ্য সরবরাহকারী দেশগুলো সংকটে পড়েছে। একইভাবে কোরিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো দেশ মধ্যবর্তী পণ্য চীনে রপ্তানি করে। চূড়ান্ত পণ্যই যদি বিক্রি না হয়, তাহলে এসব পণ্য নিয়ে তো কোনো লাভ নেই। গাড়ি থেকে শুরু করে অলংকার—সব রকমের বিলাসবহুল তৈরি পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার চীন। আর এসব পণ্যের বড় আমদানিকারক উন্নত দেশগুলো। সে কারণেই বিশ্বের সব পুঁজিবাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
প্রথম আলো: চীনের অর্থনীতি এভাবে শ্লথ হলো কেন?
আহসান এইচ মনসুর: চীন এখন বিশ্বের ‘ম্যানুফ্যাকচারিং হাব’। বিশ্বের মোট উৎপাদনের সিংহভাগ এখন চীনেই হয়। বিশ্বায়নের এ যুগে আউটসোর্সিংটাও এখন বৈশ্বিক। চীনের অর্থনীতির গতি হারানোর দুটি দিক আছে। ইউরোপ ও আমেরিকার মন্দার কারণে চীনের রপ্তানি কমে গেছে। গত কয়েক মাসে চীনের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ কমে গেছে, যেটি সচরাচর হয় না। অন্যদিকে চীনের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিও এখন মন্দা সময় পার করছে। সব মিলিয়ে চীনের অর্থনীতি খুব বেশি রপ্তানিনির্ভর, এখানে যে একটি সাম্যাবস্থার দরকার ছিল, সেটি হয়নি। শুধু রপ্তানিনির্ভরতা দিয়ে এত বড় একটি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব নয়। এখানে দেশটির অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি। এটা বাড়াতে যে ধরনের শক্তিশালী সামাজিক অবকাঠামো দরকার, সেটি তারা এখনো করতে পারেনি। সামাজিক নিরাপত্তা চীনের এখনো দুর্বল। এটির অনিশ্চয়তা থাকায় চীনা নাগরিকদের সঞ্চয় প্রবণতা খুব বেশি। উন্নত দেশগুলোর মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে সামাজিক সুরক্ষা, বিমা-চিকিৎসা ভাতার নিশ্চয়তা দিতে পারলে দেশটির অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ত। চীনা অর্থনীতিতে এখন আর নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। দেশটিতে আবাসন খাতে অনেক উচ্চ ভবন নির্মিত হলেও সেগুলো খালি পড়ে আছে। চীনের আর্থিক ব্যবস্থাপনাও খুব উন্নত নয়, মুদ্রার মানেও স্থিতিশীলতার অভাব আছে। সব মিলিয়ে অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি চীন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চীনের অর্থনীতির পতনের সঙ্গে অন্যান্য অর্থনীতির কেন পতন ঘটছে? অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো চীনে অনেক কিছু রপ্তানি করে।
দেশটির ব্যাংকিং খাতের অবস্থাও কিন্তু ভালো না। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানোর জন্য যেসব বিষয় করার দরকার ছিল, সেটা চীন করে উঠতে পারেনি। অর্থনীতির বিশালত্ব চিন্তা করলে চীনের আর্থিক খাত বেশ দুর্বল। আমাদের মতো সেখানেও অনেক মন্দ ঋণ আছে। যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকেই চীনের বেশি ঋণ নেওয়া হয়, তাই সেখানে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই হয় না। কয়েক বছর ধরে দেশটির প্রবৃদ্ধি যেখানে দুই অঙ্কের ঘরে ছিল, সেটা এবার ৫ শতাংশ হবে কি না, সন্দেহ দেখা দিয়েছে। অর্থনীতির ভাষায় বললে একটা ‘পারফেক্ট স্ট্রম’ চীনের অর্থনীতিকে ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে।
প্রথম আলো: এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসতে পারে চীন?
আহসান এইচ মনসুর: চীন বেরিয়ে আসতে পারবে কি না, এটাই এখন দেখার বিষয়। অতীতে সংকট থেকে দ্রুতই বের হয়ে আসার ইতিহাস থাকলেও এবারও যে তা হবে, তা বলা যাবে না। তবে সংকট মোকাবিলায় চীনের হাতে অনেক বিকল্পও আছে। তাদের রিজার্ভ খুব ভালো, সেখান থেকে তারা ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করতে পারে। সুদ হার ইতিমধ্যে কমিয়ে দিয়েছে, সামনে আরও কমাবে। পুঁজিবাজারে পেনশনের টাকা ব্যবহার করার সুযোগ আছে। এসব বিকল্প ব্যবহার করলেই কাজ হবে কি না, সেটাই এখন দেখতে হবে।
প্রথম আলো: বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দরপতনের কারণ কী?
আহসান এইচ মনসুর: আট-দশ বছর আগেও তেলের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সে অবস্থা থেকে বের হয়ে এসে তারা এখন উল্টো রপ্তানি করার অবস্থায় চলে এসেছে। এতে বিশ্ব তেলের বাজারে একটা দাম কমানোর প্রতিযোগিতা তৈরি করেছে। সৌদি আরবসহ অন্য তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো বাজার ধরে রাখতে প্রতি ব্যারেল ১২০ ডলার থেকে কমিয়ে ৬০ ডলারে নামিয়ে এনেছে। আবার ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় এ তেল বাজারে চলে আসায় সেটি দাম আরও কমিয়ে ৫০ ডলারে নিয়ে এসেছে। এরপর চীনের গতিমন্দা সেটা আরও কমিয়ে ৪০ ডলারে নামিয়ে এনেছে। এটা আরও কমলে তেল উৎপাদনকারী অনেক কোম্পানি হারিয়ে যাবে।
প্রথম আলো: তেলের দামের ভবিষ্যৎ কী?
আহসান এইচ মনসুর: তেলের দাম অদূর ভবিষ্যতে বাড়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা শক্তিশালী হলেও প্রবৃদ্ধি দুই থেকে আড়াই শতাংশের বেশি হবে না। ভারতের অর্থনীতিও ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে ধরা হলেও সেটি এখন অর্জিত হবে না বলেই মনে হচ্ছে। ফলে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা কোথাও তেমন দেখা যাচ্ছে না।
প্রথম আলো: অনেক দিন ধরেই তো ইউরোপে মন্দা
আহসান এইচ মনসুর: ইউরোপের অর্থনীতির মন্দাও সহজে কাটবে বলে মনে হচ্ছে না। ইউরোর যে পতন, সেটির কারণ যে শুধু গ্রিস, তা নয়। জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালির মতো বড় ইউরোপীয় অর্থনীতির দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি খারাপ। সে কারণেই ইউরোর এ দরপতন বাংলাদেশের রপ্তানির জন্য খারাপ।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের কী করা উচিত?
আহসান এইচ মনসুর: চীনসহ অনেক দেশই তাদের মুদ্রার বিনিময়মূল্য কমিয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে এখনো তা করা হয়নি। ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রকৃত বিনিময়মূল্যের দিক থেকে টাকা এখন ২০ থেকে ২৫ শতাংশ অতিমূল্যায়িত অবস্থায় চলে গেছে। টাকাকে এভাবে অতিমূল্যায়িত অবস্থায় রাখা ঠিক হবে না। ইতিমধ্যেই আমাদের রপ্তানি প্রায় ১২ শতাংশ কমে গেছে। ভারত রুপির বিনিময়মূল্য কমানোর পরও গত মাসে তাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ কমেছে। রপ্তানি সক্ষমতা ধরে রাখতে হলে টাকার বিনিময়মূল্য কমানোর কোনো বিকল্প এ মুহূর্তে নেই। রপ্তানির দিকটি মাথায় রেখেই টাকার মূল্যমান কমানোর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।
প্রথম আলো: তেলের দামের সরকারের সিদ্ধান্ত এখন কেমন হতে পারে?
আহসান এইচ মনসুর: বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকার প্রতি লিটার ডিজেলের দাম পাঁচ টাকা, আর অকটেনের দাম ১০ টাকা কমাতে পারে। তেলের দাম সমন্বয়ের ক্ষেত্রে ৬০ ডলারকে সামনে রেখে করতে হবে। তবে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার একটা ঝুঁকি আছে। বিপিসির ক্ষতি পুরোপুরি কাটেনি। সরকারের উচিত বেসরকারি খাতকে বাজারে নিয়ে আসা। বেসরকারি খাত এলে দেশের জনগণ ও বিনিয়োগকারীরা উপকৃত হবেন, সরকারের ভর্তুকি কমে আসবে। বিপিসিকে মনোপলি প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেখে আমরা জাতির ক্ষতি করছি।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আশরাফুল ইসলাম