বিশ্ববাজারে আর কত কমলে দেশে দাম কমবে?

.
.

আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম কমে ব্যারেলপ্রতি মাত্র ৩৬ ডলার ৫ সেন্টে নেমে গেছে। এটি ২০০৪ সাল-পরবর্তী গত ১১ বছরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের সর্বনিম্ন দাম।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ক্রমাগতভাবে কমতে থাকায় সেটির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, স্থানীয় বাজারে দাম কিছুটা কমানো হলে বিনিয়োগ বাড়বে, শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচ ও পরিবহন ভাড়া কমবে। মূল্যস্ফীতিও নিম্নমুখী হবে। সার্বিকভাবে এগুলোর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে ভোক্তা পর্যায়ে।
কিন্তু সরকারের তরফ থেকে তেমন পদক্ষেপ নেওয়ার লক্ষণ নেই। বরং বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়তে শুরু করলে বাংলাদেশেও দাম বাড়ানো হতে পারে। অবশ্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) কথা দিয়েছেন, দাম বাড়ালেও তা বিশ্ববাজারের দরের সঙ্গে ১০ টাকার বেশি পার্থক্য হবে না।
জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববাজারে দাম কমায় এখন সরকার পুরোপুরি না হলেও অন্তত আংশিকভাবে দাম কমাতে পারে। যেমন প্রতি লিটার ডিজেলে ১০ ও পেট্রলে ২০ টাকা করে কমালেও সরকারের কোনো ক্ষতি হবে না, অনেক লাভ থাকবে।
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, তেল আমদানিকারক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত। সে জন্য প্রতিবেশী ভারতের মতো বাংলাদেশও তেল আমদানি ও বিপণন কার্যক্রম উদার করে দিতে পারে, যাতে বেসরকারি খাতও প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করার সুযোগ পায়।
ঢাকায় গতকাল মঙ্গলবার বিনিয়োগ বোর্ড আয়োজিত এক সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে। তাঁর মতে, পেট্রলের দাম কমালে মূল্যস্ফীতি কমবে।
অবশ্য ওই সেমিনারে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ-বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘পেট্রলের দাম কমালেই বিনিয়োগ বাড়বে, সেটি আমি জানি না। আমি এটি সমর্থনও করি না। আমি অনেক অর্থনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁরাও প্রমাণ করতে পারেননি। ... জ্বালানি তেলের দাম কমালে মূল্যস্ফীতি কমবে বলেও আমি মনে করি না।’
অনেক দিন ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশে তা কমানো হয়নি। এতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) পরিচালন মুনাফা বেড়েছে এবং সংস্থাটি প্রথমবারের মতো দেনাও কমাতে পারছে।
বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ২০০৮ সালে শুরু হয়ে কয়েক বছর ধরে চলা মন্দার সময়ও এতটা নিচে নামেনি পণ্যটির দাম।
আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে তেলের সরবরাহ যেন উপচে পড়ছে। সে জন্যই মূলত পণ্যটির দামে নাটকীয় পতন ঘটেছে।
তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জোট ওপেক উত্তোলন ও সরবরাহ কমানোর সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ আর কিছু দেশ নিজস্ব উৎস থেকে আহরণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম তরতর করে কমছে। তাতে ইউএস ক্রুড তেলের দামও কমে ৩৪ ডলার ১৭ সেন্টে নেমেছে, যা ২০০৯ সালের পর সর্বনিম্ন।
অথচ মাত্র আড়াই বছর আগে ২০১৪ সালের জুনে বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ছিল ১১৫ ডলার।
বিশ্লেষক ও জ্বালানি তেল খাতের কর্তাব্যক্তিদের কণ্ঠেও এখন ধ্বনিত হচ্ছে নিরাশার কথা। তাঁরা মনে করেন, বর্তমান নিম্নমুখী প্রবণতা থেকে তেলের দাম ঘুরে দাঁড়ানোর আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে রাশিয়া ইতিমধ্যে তেলের সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রও ১৮ ডিসেম্বর থেকে নিজস্ব তেল রপ্তানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। ফলে দেশটি যেকোনো সময়ই আন্তর্জাতিক বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে তেল রপ্তানি শুরু করতে পারে। এ ছাড়া ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ফলে আসন্ন ২০১৬ সালে সেই দেশের তেলও ঢুকবে বাজারে। তাদের কাছেও রয়েছে তেলের বিশাল মজুত।
কোনো কোনো বিশ্লেষক অবশ্য মনে করেন, তেল রপ্তানিকারক প্রধান দেশগুলো এক অর্থে দাম কমা ও সরবরাহ বৃদ্ধির গ্যাঁড়াকলেই রয়েছে। কারণ, দাম কমে যাওয়ার পরিস্থিতিতে এসব দেশের সামনে এখন রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ধরে রাখতে উত্তোলন ও সরবরাহ বেশি রাখার ভালো কোনো বিকল্প নেই।
গোল্ডম্যান স্যাকস ও সিটিগ্রুপ গত সপ্তাহে আবারও বলেছে, অত্যাসন্ন নতুন বছরে (২০১৬ সাল) বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম কমে ২০ ডলারেও নেমে আসা সম্ভব।
সূত্র: বিবিসি ও ইয়াহু ডট কম।