বাঁধ কোনো বাধা নয়

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করে এখন সেখানেই প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন অমিত ইমতিয়াজ
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করে এখন সেখানেই প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন অমিত ইমতিয়াজ

‘নবায়নযোগ্য শক্তির চাহিদা মেটাতে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো দেশের কোথাও কোথাও জলবিদ্যুৎ​কেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজন হতে পারে। আমি “মডেল” হিসেবে ধরেছি বান্দরবানের আলীকদম গ্রামটিকে। এসব ক্ষেত্রে সমস্যা যেটা হয়, জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের বাঁধের পেছনের বিশাল হ্রদের জন্য সেখানকার দরিদ্র অধিবাসীদের অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে হয়। এতে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে সামগ্রিক পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থানে। তাই আমি এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে নতুন করে ভেবেছি।’ বলছিলেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের নবীন স্থপতি অমিত ইমতিয়াজ। কী তাঁর ভাবনা? অমিত বলেন, ‘আমার নকশা অনুযায়ী, জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের বাঁধের মধ্যেই স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য তৈরি হবে বাসস্থান, স্কুল ও হাসপাতাল। বাঁধটিই হবে বাস্তুহারা মানুষের নতুন ঠিকানা।’

এই অভিনব নকশার ধারণা দিয়েই আর্কিপ্রিক্স ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় হানটার ডগলাস পুরস্কারের মনোনয়ন পেয়েছেন অমিত। নতুন প্রজন্মের সেরা স্থপতিদের খুঁজে বের করতে দুই বছর পরপর এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নেয় এমআইটি, হার্ভার্ডের মতো নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যের সেরা প্রকল্পগুলো। অমিত জানালেন, বাংলাদেশ থেকে তিনিই প্রথম এই প্রতিযোগিতায় মনোনয়ন পেয়েছেন।

কেন এই প্রকল্পটি বেছে নিলেন? প্রশ্ন শুনে অমিতের জবাব, ‘শেষ বর্ষের প্রজেক্ট সাবমিটের মানবকল্যাণের কাজে আসবে, এমন কিছু করার ইচ্ছা ছিল। জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের বিভিন্ন সমস্যার কথা ভেবে মাথায় আসে, একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে কীভাবে তার আশপাশের পরিবেশ ও মানব বসতির সঙ্গে এক করে দেওয়া যায়। এরপর আমার প্রজেক্ট সুপারভাইজার মোহাম্মদ নাজমুল লতিফ সোহাইল স্যারের পরামর্শে এই প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করি।’

অমিতের করা বাঁধের নকশা
অমিতের করা বাঁধের নকশা

অমিত তাঁর প্রকল্পের গঠন সম্পর্কে বলেন, জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের বাঁধের পেছনে থাকে লম্বালম্বিভাবে নির্মিত কয়েকটি প্রশস্ত দেয়াল। দেয়ালগুলো বাঁধটিকে দাঁড় করিয়ে রাখতে বিশেষভাবে নির্মাণ করা হয়। অমিত বলেন, বাঁধের পেছনের এই দেয়ালগুলো ব্যবহার করেই তিনি গ্রামটির নকশা করেছেন। নকশায় পরপর দুটি দেয়ালের মধ্যবর্তী খালি জায়গাগুলোতে আছে স্থানীয় মানুষের থাকার জায়গা, শিক্ষা ও সেবার বন্দোবস্ত। পরিবেশের সঙ্গে যোগসূত্র রেখে বাঁধের ভেতরের নকশা করা হয়েছে আলীকদম গুহার আদলে। এ ছাড়া যোগাযোগ ও মানুষের সংস্কৃতির দিকটিও প্রাধান্য পেয়েছে অমিতের প্রকল্পে।

প্রকল্পটি সম্পর্কে চুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সজল চৌধুরী বলেন, ‘নব্য প্রতিষ্ঠিত চুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের জন্য এই প্রকল্প ও এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি একটা বড় পাওয়া। এটি নবীন স্থপতিদের অনুপ্রাণিত করবে। একই সঙ্গে সবাইকে জানিয়ে দেবে, আমাদের অসাধ্য বলে কিছু নেই।’

অমিতের এই প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে ছিলেন চুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ নাজমুল লতিফ সোহাইল, সহকারী অধ্যাপক সজীব পাল ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাকিউল ইসলাম। মোহাম্মদ নাজমুল লতিফ বলেন, বাংলাদেশিদের মধ্যে অমিতই প্রথম আর্কিপ্রিক্সে মনোনয়ন পাওয়ায় বিশ্বে বাংলাদেশের স্থাপত্য শিক্ষা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হবে।

মনোনীত প্রতিযোগী হিসেবে আগামী ১ ফেব্রুয়ারি অমিত ভারতের আহমেদাবাদের সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল প্ল্যানিং অ্যান্ড টেকনোলজি (সেপ্ট) বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিযোগিতার মূল আয়োজনে অংশ নেবেন। সেখানে ২৩ জন মনোনীত প্রতিযোগী তুলে ধরবেন নিজের প্রকল্প। এ ছাড়া তাঁরা অংশ নেবেন বাসযোগ্য স্থাপনা নির্মাণসংক্রান্ত ১০ দিনব্যাপী কর্মশালায়। প্রকল্পের বহুমাত্রিকতা তুলে ধরতে এবারই প্রথম প্রতিযোগিতার মনোনীত প্রকল্পগুলোর মডেল তৈরি করা হবে সেপ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেখানে অমিতের প্রকল্পটিও থাকছে।

মনোনয়ন নিয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে অমিত ইমতিয়াজ বলেন, ‘আহমেদাবাদে বিভিন্ন দেশের স্থপতিদের কাছে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে পারব, সে বিষয়টাই মুখ্য। সেখানে সবাই জানবে বাংলাদেশের স্থাপত্যের কথা, এটাই সবচেয়ে আনন্দের।’ চুয়েটের স্থাপত্য বিভাগে স্নাতক শেষে বর্তমানে নিজের বিভাগেই প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন অমিত। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘সব সময় ইচ্ছে করে ভাবনা আর উদ্ভাবনের নতুন জগৎ তৈরি করতে। শিক্ষকতার পাশাপাশি একজন বড় স্থপতি হওয়ার স্বপ্নটাও লালন করি।’