তিন প্রজন্মের কলেজ

আর পাঁচ বছর পরই এই কলেজ শতবর্ষী হবে। ছবি: প্রথম আলো
আর পাঁচ বছর পরই এই কলেজ শতবর্ষী হবে। ছবি: প্রথম আলো

অন্তরা রানী দাস ফেনী সরকারি কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পড়ছেন। প্রথম বর্ষের ছাত্রী হলেও এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা বহু পুরোনো। অন্তরার বাবা কাঞ্চন কান্তি দাস, দাদা গোপাল চন্দ্র দাসও এই কলেজে লেখাপড়া করেছেন। বাবা এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। দাদা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। অন্তরা বলছিলেন, ‘দাদার অনুপ্রেরণায়ই আমি এই কলেজে ভর্তি হয়েছি। বাবা আর দাদার কাছে তাঁদের সময়ে ক্যাম্পাস কেমন ছিল, সেসব গল্প শুনেছি। পূর্বপুরুষদের স্মৃতিবিজড়িত প্রতিষ্ঠানে পড়ছি, এই ভালো লাগাটা অন্য রকম।’

অন্তরার মতো এই ‘অন্য রকম ভালো লাগা’টা অবশ্য ফেনী সরকারি কলেজের আরও অনেকেই টের পান। তাঁদের মধ্যে শিক্ষার্থী যেমন আছেন, আছেন শিক্ষকও। উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মোশারফ হোসেন যেমন বলছিলেন, ‘আমি এই কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়েছি। আমার বাবাও এই কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেছেন।’ সমাজকর্ম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফখরুল আমিন বললেন, তাঁর নানা এখানকার ছাত্র ছিলেন। বোঝা গেল, পাঁচ বছর পর যখন কলেজের ১০০ বছর পূর্তি হবে, তিন প্রজন্মের মিলনমেলায় উৎসবমুখর হয়ে উঠবে ফেনী সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণ।

কলেজ ক্যাম্পাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা হলো কদিন আগে। তাঁরা যেমন কলেজের ঐতিহ্যের কথা বললেন, তেমনি শোনা হলো অনেক না-পাওয়ার গল্পও। প্রিয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি ভালো লাগা আছে ঠিকই, কিন্তু শিক্ষার্থীদের অভিযোগও কম নয়।

এই স্মৃতিশৌধ শিক্ষার্থীদের মনে করিয়ে দেয় ক্যাম্পাসের গৌরবের ইতিহাস
এই স্মৃতিশৌধ শিক্ষার্থীদের মনে করিয়ে দেয় ক্যাম্পাসের গৌরবের ইতিহাস

পেছনে ফিরে

১৯২২ সালে অল্প কজন শিক্ষার্থী নিয়ে ফেনী কলেজের যাত্রা শুরু। এখন এই প্রতিষ্ঠানে পড়ছেন প্রায় ২২ হাজার ছাত্রছাত্রী। ১৯৭৯ সালে কলেজটি জাতীয়করণ করা হয়। কলেজে বর্তমানে শিক্ষক রয়েছেন ৬৪ জন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১: ৩৪৪ জন। অবশ্য এর বাইরে কয়েকজন অতিথি শিক্ষকও রয়েছেন। বর্তমানে ১৫টি বিষয়ে অনার্স এবং ১০টি বিষয়ে মাস্টার্স প্রথম পর্ব ও ৯টি বিষয়ে মাস্টার্স শেষ পর্ব চালু আছে। এ ছাড়া প্রাইভেট ডিগ্রি ও মাস্টার্স শেষ পর্বও রয়েছে।

কলেজটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন বৃহত্তর নোয়াখালীতে (ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলা) এটিই ছিল উচ্চশিক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান। মজার ব্যাপার হলো, ফেনী সরকারি কলেজ থেকেই আরও একটি কলেজের জন্ম হয়েছে। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ সৈন্যরা ফেনী কলেজে অবস্থান নেয়। তখন কয়েক বছরের জন্য কলেজটিকে ‘ফেনী কলেজ’ নামে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্থানান্তর করা হয়। যুদ্ধ শেষে কলেজটি আবার ফেনীতে ফিরে আসে। তখন সেখানে ওই অবকাঠামোর ওপরই ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

ফেনী সরকারি কলেজের পাঠাগার
ফেনী সরকারি কলেজের পাঠাগার

শুধু নেই আর নেই

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানালেন, এখানে শিক্ষকসংকট প্রবল। এনাম কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, কলেজে শিক্ষকের পদ হওয়ার কথা ১৫২টি। অনার্স ও মাস্টার্সের প্রতিটি বিষয়ে শিক্ষক প্রয়োজন ১২ জন। বর্তমানে অধিকাংশ বিষয়ে চারজনের বেশি শিক্ষক নেই। ওদিকে শ্রেণিকক্ষের সংকটও শিক্ষার্থীদের জন্য বড় অন্তরায়। প্রতিটি বিভাগের জন্য মাত্র দুটি করে শ্রেণিকক্ষ। তাই সব বর্ষের পাঠদান একই সময়ে সম্ভব হয় না। এ ছাড়া সারা বছর পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি, ডিগ্রি, অনার্স, মাস্টার্স ও প্রাইভেট পরীক্ষার কারণে শিক্ষার্থীদের ‘নিয়মিত ক্লাস’ প্রায়ই বন্ধ থাকে।

বিজ্ঞান ভবন নেই বলে বিজ্ঞান বিভাগের কার্যক্রম চলে কলা ভবনে। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি নেই। কলেজের অতি পুরোনো ও পরিত্যক্ত ভবনে একটি লাইব্রেরি থাকলেও সেটিতে স্থানসংকুলান হয় না। বর্ষায় পানি পড়ে এরই মধ্যে অনেক বই নষ্ট হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবহনের সুবিধা নেই। একমাত্র ছাত্রাবাসটিতে মাত্র ১০০ জনের থাকার ব্যবস্থা আছে, সেটিও কলেজ থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। কলেজ চত্বরের দুটি একতলা ছাত্রাবাস ও অধ্যক্ষের বাসভবন দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। শিক্ষকদের জন্য নেই কোনো ডরমিটরি।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

এই কলেজের বহু শিক্ষার্থী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। কলেজের সাবেক ছাত্র মেজর সালাউদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম) হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। আরেক সাবেক ছাত্র ও সাবেক মন্ত্রী জাফর ইমাম (বীর বিক্রম) মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর সাব-সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ফেনী হানাদারমুক্ত হয়।

১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে পাকিস্তানি সেনারা ফেনী কলেজে ‘সেনা ক্যাম্প’ স্থাপন করে। সে সময় বহু মানুষকে কলেজ ক্যাম্পাসে হত্যা করা হয়েছিল। কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ফজলুল হককেও রাজাকারদের সহায়তায় ধরে নিয়ে পাকিস্তানি হানাদাররা নির্মমভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর কলেজ প্রাঙ্গণে একটি বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।

আবুল কালাম আজাদ
আবুল কালাম আজাদ

সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করা জরুরি
আবুল কালাম আজাদ
অধ্যক্ষ, ফেনী সরকারি কলেজ
‘কলেজের পড়ালেখার মান উন্নত করতে হলে আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করা জরুরি। ভালো অবকাঠামো, ছাত্রাবাস, শিক্ষকদের জন্য আবাসন খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। তবু আমি মনে করি, আমাদের এখানে শিক্ষার মান ভালো। এ অঞ্চলে ফেনী সরকারি কলেজই সেরা। উচ্চমাধ্যমিকে ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করছে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ফলাফলও ভালো। আমরা আমাদের অতীতের গৌরব ধরে রাখতে চেষ্টা করছি।’