ক্যাম্পাস জুড়ে নজরুল

ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজে আছে নজরুলকে নিয়ে গবেষণার সুযোগ। ছবি: লেখক
ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজে আছে নজরুলকে নিয়ে গবেষণার সুযোগ। ছবি: লেখক

জাতীয় কবি কখনোই কেবল কবি ছিলেন না। ছিলেন দারুণ একজন গল্পকার। সাহিত্যজীবন শুরুও করেছিলেন গল্প দিয়ে। বিভিন্ন সময়ে বিচিত্র ঢঙে নানান রঙের গল্প বলে গেছেন তিনি।‘অগ্নিগিরি’ তেমনি এক উল্লেখযোগ্য গল্প। অগ্নিগিরির সমস্তজুড়ে আছে ময়মনসিংহের ত্রিশাল। দূর থেকে ত্রিশালে পড়তে আসা এক যুবকের গল্প। ত্রিশালের পথ, বৃক্ষ, বিল আর জনপদে সেই যুবকের বিচরণ। এই গল্পের নায়কের মতো নজরুল নিজেও দূর আসানসোল থেকে ত্রিশাল এসেছিলেন। এখানকার বিদ্যালয়ে পড়েছেন। দুচোখ মেলে প্রকৃতির রূপ দেখেছেন। উদাস মনে বাজিয়েছেন বাঁশি। কান সজাগ রেখে এখানকার পাখির গান শুনেছেন। প্রাণভরে নিয়েছেন ফুলের সুবাস। মাত্র এক বছর ছিলেন। কিন্তু নিয়ে গেছেন উদাস করা প্রকৃতির সময়হীন অজস্র স্মৃতি। দিয়ে গেছেন তারও বেশি কিছু। আকাশ-বিল-মাটির বুকে প্রেম, বিদ্রোহ আর কল্পনার ফুল ফুটিয়ে গেছেন। সেই ফুলগুলো হাজার আলোর রং নিয়ে আজও ফুটে আছে।

কবির নামে ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়। কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণে সদামুখর এই ক্যাম্পাসে বিদ্রোহী কবির উজ্জ্বল উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের অদূরে স্থাপিত এই ক্যাম্পাসের এক কোণে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাচীন বটগাছ। কথিত আছে নজরুল এই গাছের ছায়ায় বসে বাঁশি বাজাতেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষার্থী সেই গাছের ছায়ায় বসে কল্পনার চোখে আজও কবিকে দেখতে পায়। অদেখা স্মৃতি থেকে গ্রহণ করে অফুরান অনুপ্রেরণা।

ক্যাম্পাসের প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে আছে কবির ম্যুরাল, ছবি; তাঁর গান আর কবিতার বাণী। এখানে স্মৃতিস্তম্ভের নাম ‘চির উন্নত মম শির’, ক্যাফেটেরিয়ার নাম ‘চক্রবাক’। ‘অগ্নিবীণা’ আর ‘দোলনচাঁপা’ আবাসিক হলের নাম। বাসের নাম ‘প্রভাতি’, ‘ঝিঙেফুল’, ‘বিদ্রোহী’, ‘প্রলয়শিখা’। মঞ্চের নাম ‘চুরুলিয়া’, ‘গাহি সাম্যের গান’। এই ক্যাম্পাসে চলতে-ফিরতে, উঠতে-বসতে কবির নাম, ছবি আর তাঁর অমর সাহিত্যকর্মের সঙ্গে প্রতিনিয়ত নতুন করে পরিচিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী অন্তর পালের ভাষায় ‘আমাদের এই ক্যাম্পাস বিশেষ কারণ এটা একজনের কবির নামে উজ্জ্বল। সকাল হলেই নজরুলের গানের সুর শোনা যায়। সেই সুরে মুগ্ধ হয়ে আমরা ছবি আঁকি।’ সংগীত বিভাগের ছাত্রী সেতু হালদার নজরুলের জীবনী দ্বারা আজীবন অনুপ্রাণিত। এই ক্যাম্পাসে বসে নজরুলের গানের চর্চা করার অনুভূতি তাঁর মতে অতুলনীয়। একই বিভাগের ছাত্র সমুদ্র প্রবাল বেশ গর্বের সঙ্গে বলল, ‘নজরুলের গানের চর্চার জন্য আমাদের ক্যাম্পাসই সেরা।’

নজরুল স্মরণে তৈরি স্মৃতিস্তম্ভ
নজরুল স্মরণে তৈরি স্মৃতিস্তম্ভ

একটি সাধারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে কলা, ব্যবসায় শিক্ষা, সামাজিক বিজ্ঞান বা ফলিতবিজ্ঞানের ১৯টি পৃথক বিষয় পড়ার সুযোগ রয়েছে এখানে। যে যে বিষয়েই পড়ুক, নজরুলকে সবাই আপন করে নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুলকে জানার ও বোঝার নানা সুযোগ রয়েছে। প্রতিটি বিভাগেই বাধ্যতামূলক কোর্স হিসেবে ‘নজরুল স্টাডিজ’ পড়তে হয়। নজরুলকে নিয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে নজরুলের বই নিয়ে আছে আলাদা কর্নার।

নজরুলের নাটক নিয়ে বাংলাদেশে তুলনামূলক অনেক কম কাজ হয়েছে। মঞ্চ আর বেতারের জন্য তিনি বেশ কিছু অসাধারণ নাটক রচনা করলেও এ দেশের পাঠক, শ্রোতা, দর্শক অনেকেই সেসবের সঙ্গে পরিচিত নন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১১ সালে চালু হয় নাটক বিভাগ। এই বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ইমরান হাসান শিমুল জানাল নজরুলের নাটকে তাঁর ভীষণ আগ্রহের কথা। মঞ্চের জন্য নজরুলের নাটক ‘শিল্পী’ নির্দেশনা দেওয়া আর শিল্পী চরিত্রে অভিনয় করার অনুপম স্মৃতি মনে করে সে বেশ উদ্বেলিত। নজরুলকে নতুন আঙ্গিকে জানতে পেরে তার চোখেমুখে পরিতৃপ্তির ছাপ বেশ স্পষ্ট।

কথিত আছে এই গাছের নিচে বসেই বাঁশি বাজাতেন নজরুল
কথিত আছে এই গাছের নিচে বসেই বাঁশি বাজাতেন নজরুল

প্রতিবছর মে মাসে ক্যাম্পাসে কেন্দ্রীয়ভাবে বেশ ঘটা করে আয়োজন করা হয় তিন দিনব্যাপী নজরুল জন্মোৎসব। এটি আদতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় আয়োজন। দুই বাংলার নজরুলপ্রেমী, নজরুলের গানের শিল্পী, কবি আর নজরুল বিশেষজ্ঞদের পদচারণে তিন দিন ক্যাম্পাস থাকে দারুণ রঙিন। ক্যাম্পাসজুড়ে নজরুল-মুগ্ধতার রং আর সুর ছড়ানো থাকে। এক মঞ্চে যখন নজরুলের জীবন আর কর্ম নিয়ে আলোচনা চলছে, আরেক মঞ্চে তখন নজরুলের গান। গ্যালারিতে চলে শিল্পকর্মের প্রদর্শনী। ছাত্রদের তরুণ উদ্যোগে আয়োজন করা হয় আলোকচিত্র আর চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী কল্লোল কুমার রায়ের মতে ওই তিনটা দিন যেমন অপার আনন্দের, তেমনি শিক্ষণীয় অনেক কিছুর সন্ধান মেলে। ‘কবিকে নানাভাবে, নানা উপায়ে জানার সুযোগ হয়।’

চির আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক আর সদা তরুণ নজরুল ত্রিশালের এই গ্রামীণ আবহের উদার ক্যাম্পাসের সর্বত্র আজও মুক্তি আর সাম্যের সুবাস ছড়িয়ে যাচ্ছেন প্রতিদিন। ক্লাসরুম থেকে শুরু করে খেলার মাঠ, ক্যাফেটেরিয়া থেকে বটগাছের ছায়া, পরীক্ষা থেকে শুরু করে নাচ-গান-ছবি-কবিতা-সকল সময়, সমস্ত সবুজ মনে কবি নজরুল জ্বালিয়ে রেখেছেন বিদ্রোহের আলো আর ফুটিয়ে যাচ্ছেন মানবপ্রেমের অসংখ্য কেয়া, হাসনাহেনা আর দোলনচাঁপা।

লেখক: প্রভাষক, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়