অনিয়মে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকই এখন হর্তাকর্তা

>

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যাল
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যাল

* অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তা|
*দুই কোটি টাকার উপাচার্যের বাড়ি এখন কার্যালয়|
* নিয়মিত শিক্ষার খারাপ অবস্থা, সান্ধ্য কোর্স রমরমা

উচ্চমাধ্যমিকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাস করেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকর্মে দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতক (সম্মান)। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি থাকার সময় ২০১০ সালের আগস্টে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিজ সংগঠনের এক কর্মী খুনের ঘটনায় সংগঠন থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কৃত হন। সেই ঘটনার জের ধরে সেখানে স্নাতকোত্তর শেষ না করেই ক্যাম্পাস ছাড়েন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সান্ধ্য কোর্সে (নিয়মিত কোর্স নয়) স্নাতকোত্তর পাস করেন, ফল সিজিপিএ-৩ দশমিক ৩৪।

সুবিধা দিয়ে ওই প্রার্থীকে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক করা হয়েছে। তাঁর নাম আওয়াল কবির। সমাজকর্মে পড়াশোনা করলেও তাঁকে প্রথমে অ্যাডহক ভিত্তিতে একটি ইনস্টিটিউটে নিয়োগ দেওয়া হয় সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক পদে। পরে আবার স্থানান্তর ও স্থায়ী করা হয় সমাজকর্ম বিভাগে। আওয়াল কবির এখন ওই বিভাগের চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং প্রক্টর হয়ে কার্যত বিশ্ববিদ্যালয়টিই নিয়ন্ত্রণ করছেন।

এটি পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডিত চিত্র মাত্র। বর্তমান প্রশাসনের আমলে শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ, ভর্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা অনিয়মের প্রচুর অভিযোগ উঠেছে। পছন্দের প্রার্থীকে শিক্ষক করতে প্রথমে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অ্যাডহক ও খণ্ডকালীন নিয়োগ দেওয়া হয়, পরে ‘রফা’ করে তাঁদের স্থায়ী করা হয় বলে অভিযোগ আছে।

শুধু তা-ই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়টি এখনো নিজের পায়েই দাঁড়াতে পারেনি, একজন অধ্যাপকও নেই। তারপরও সান্ধ্য স্নাতকোত্তর কোর্স খোলা হচ্ছে। যেখানে পড়াশোনার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ছাড়া প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে উপাচার্যের জন্য বাড়ি করলেও সেখানে না থেকে ভাড়া বাড়িতে থাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংরক্ষিত তহবিল নয়ছয় করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিবেদন

প্রথম আলোর অনুসন্ধান ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক গোপন প্রতিবেদনে বর্তমান উপাচার্যের আমলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষার্থীরা যদি অনিয়ম ও দুর্নীতির পরিবেশে শিক্ষাজীবন শেষ করেন, তবে তাঁরা কর্মক্ষেত্রে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। প্রতিবেদনে সার্বিক বিষয় তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

অবশ্য উপাচার্য আল-নকীব চৌধুরী সব অনিয়ম অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, আগের ধারাবাহিকতায় প্রথম দিকে 
অ্যাডহক ভিত্তিতে কিছু নিয়োগ হলেও তিনিই তা বন্ধ করেছেন। বরং তিনি যতই নিয়মে ঢুকছেন, ততই শত্রু ঢুকছে। আওয়াল কবিরের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, এটা সত্য যে, তাঁর চেয়েও হয়তো যোগ্য প্রার্থী আছে। কিন্তু ‘টপক্লাস’ যোগ্যতা না হলেও নীতিমালা অনুযায়ী তাঁর যোগ্যতা আছে। তবে বর্তমানে সেরা ছাত্রদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।

শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ

২০০৮ সালে পাবনা সদর উপজেলার রাজাপুর এলাকায় ৩০ একর জায়গার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ২১টি বিষয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে।

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষক আছেন ১৪০ জনের মতো। বর্তমান উপাচার্যের আমলে নিয়োগ দেওয়া হয় প্রায় ৫০ জনকে। প্রথম আলোর অনুসন্ধান ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গোপন প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমান উপাচার্যের আমলে ৩০ জনের মতো শিক্ষককে অস্থায়ী ও খণ্ডকালীন নিয়োগ দেওয়া হয়। সবচেয়ে আলোচিত নিয়োগটি হয় ২০১৪ সালের ২৮ এপ্রিল। ওই সময় নানা কায়দা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি আওয়াল কবিরকে নিয়োগ দিতে গিয়ে কয়েক দফা অনিয়ম করা হয়। এখন নিয়োগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই তাঁর প্রভাব। তাঁর নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক মিলে ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তার করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানতে চাইলে আওয়াল কবির প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ আছেন। প্রক্টর হিসেবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে মারামারি থামানোসহ আইনশৃঙ্খলার বিষয়টি দেখেন। অন্য কোনো বিষয়ে তিনি হস্তক্ষেপ করেন না। আর তাঁর নিয়োগটি যথাযথ নিয়ম মেনেই হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

পুরকৌশল, অর্থনীতি এবং কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগে তিন প্রভাষককে যোগ্যতায় ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আরও কয়েকটি বিভাগে এমনই অনিয়মের অভিযোগ আছে। এখন পর্যন্ত অ্যাডহক ভিত্তিতে ও খণ্ডকালীন নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের মধ্যে কমপক্ষে ১৩ জনকে স্থায়ী করা হয়েছে।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষক নিয়োগে অস্থায়ী ও খণ্ডকালীন নিয়োগ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে তাঁরা ব্যবস্থা নিচ্ছেন এবং নেবেন। শিক্ষকতা পেশায় কোনোভাবেই নিম্ন মেধার প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া উচিত নয়। নিম্ন মেধার শিক্ষক হলে নিম্ন মেধার শিক্ষার্থী তৈরি করবে।

কোটি টাকার বাড়ি এখন অফিস

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে উপাচার্যের জন্য প্রায় দুই কোটি টাকা খরচ করে দোতলা বাসভবন নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু সেই বাড়িতে উপাচার্য থাকেন না। থাকেন শহরে আগে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নেওয়া ‘গ্রিন হাউস’ নামের একটি ভাড়া বাড়িতে। এই বাড়ির ভাড়াও দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন কর্মকর্তা বলেন, এখন উপাচার্যের বাড়িতে ডিনসহ একাধিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

নিয়মিত শিক্ষায় হিমশিম, সান্ধ্য কোর্স রমরমা

বিশ্ববিদ্যালয়টি এখনো নানা সমস্যায় জর্জরিত। কিন্তু এর মধ্যেই পাঁচটি বিভাগে (একটিতে ছাত্র পাওয়া যায়নি) সান্ধ্য স্নাতকোত্তর কোর্স চালু করা হয়েছে। সম্প্রতি ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা গেছে, সান্ধ্য কোর্সের শিক্ষার্থীদের আনাগোনা। অভিযোগ আছে, এই কোর্সে সনদসর্বস্ব শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। দুই বছর মেয়াদি সান্ধ্য কোর্সে শিক্ষার্থীপ্রতি দিতে হয় এক লাখ থেকে এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা। আবার দেড় বছর মেয়াদি এক্সিকিউটিভ কোর্সে ২০ হাজার টাকা কম দিতে হয়। ৩০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে বাকি টাকা ভাগ করে নেন শিক্ষকেরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, অর্থনীতিসহ কয়েকটি বিভাগে সেশনজট শুরু হলেও তা দূর করার কার্যকর উদ্যোগ নেই। বরং শিক্ষকেরা সান্ধ্য কোর্সের প্রতি বেশি আগ্রহী।

এ বিষয়ে উপাচার্য বলেন, এটা সত্য যে জ্যেষ্ঠ ও পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ না করে আরেকটি শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখা কঠিন। কিন্তু শিক্ষকেরা বলেছেন, কিছুটা আর্থিকভাবে উপকৃত হবেন, সে জন্য যেন এই কোর্স চালু করা হয়। তাঁরা কথা দিয়েছেন, এ জন্য নিয়মিত কোর্স ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।