নতুন ঠিকানার অপেক্ষায়

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন এই শিক্ষার্থীরা। ছবি: খালেদ সরকার
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন এই শিক্ষার্থীরা। ছবি: খালেদ সরকার

মূল ফটকের কাছেই চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসেছেন এক ছাত্র। টেবিলের গায়ে একটা ব্যানার ঝোলানো হয়েছে। ওপরে লেখা আছে, ‘জয়েন দ্য অরেঞ্জ আর্মি।’ বোঝা গেল, কোনো একটা দলে নতুন সদস্য যোগ করতে নাম নিবন্ধন চলছে। কিন্তু ‘অরেঞ্জ আর্মি’রা কারা? প্রশ্নটা মাথায় রেখেই পা বাড়াই ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) ভেতরের দিকে। ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাস। তবে খুব শিগগির তাদের ঠিকানা বদল হচ্ছে। খবরটা নিশ্চিত করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম রিজওয়ান খান। বললেন, ‘আগামী জানুয়ারি মাসেই আমরা সাঁতারকুলে আমাদের স্থায়ী ক্যাম্পাসে চলে যাচ্ছি।’ অর্থাৎ ধানমন্ডিতে এটাই ইউআইইউয়ের শিক্ষার্থীদের শেষ সেমিস্টার।

নতুন ক্যাম্পাস, নতুন ঠিকানা, নতুন ঘরও বটে। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাজ করছে চাপা রোমাঞ্চ। এ বছর ইউআইইউয়ের পয়লা বৈশাখের উৎসব আয়োজন করা হয়েছিল সাঁতারকুলের স্থায়ী ক্যাম্পাসে। সেখান থেকে ঘুরে এসে শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা বেড়েছে আরও। বিশাল মাঠ, আধুনিক ভবন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ বিঘা জায়গার ওপর নতুন ক্যাম্পাস তৈরি হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা দাবি করলেন, ঢাকার ভেতর এত বড় ক্যাম্পাস আর কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। উপাচার্য জানালেন, যেসব শিক্ষার্থীর বাসা ধানমন্ডির আশপাশে, তাঁদের কথা মাথায় রেখে চাহিদা অনুযায়ী বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাসগুলো ধানমন্ডি থেকে সাঁতারকুলে আসা-যাওয়া করবে।

ডিবেট ক্লাবের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এনেছেন বেশ কয়েকটি পুরস্কার
ডিবেট ক্লাবের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এনেছেন বেশ কয়েকটি পুরস্কার

নতুন ঠিকানায় যাওয়ার আনন্দ যেমন আছে, তেমনি পুরোনোর প্রতি একটা অদ্ভুত মায়াও অস্বীকার করা যাচ্ছে না। ধানমন্ডির ক্যাম্পাসের ক্যানটিন, লাইব্রেরি, ক্লাসরুমের দেয়ালে দেয়ালে জমে আছে ছেলেমেয়েদের কত স্মৃতি! কত বন্ধুত্ব, অর্জন, পরিশ্রম কিংবা বেদনার গল্প। গত বৃহস্পতিবার ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ঘুরে এসব কথা শুনতে শুনতে সকাল-দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল।

গবেষণা, অর্জন ও আয়োজন

ইউআইইউয়ের ছাদে গড়ে উঠেছে সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ নামের আধুনিক গবেষণাগার। সেখানে নবায়নযোগ্য শক্তির বিষয়ে কাজ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী। সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে তাঁর বিভিন্ন গবেষণা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। গতকালই প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’তে তাঁর কার্যক্রম নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এই গবেষণা থেকে শিক্ষার্থীরা কীভাবে লাভবান হচ্ছেন? প্রশ্নের উত্তরে শাহরিয়ার বললেন, ‘আমার সঙ্গে গবেষণা সহকারী হিসেবে ওরা কাজ করছে। শেষ বর্ষের ২৪ জন শিক্ষার্থী নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ নিয়ে তাঁদের থিসিস পেপার লিখছে।’

এখানে আছে অ্যাডভান্সড ইন্টেলিজেন্ট মাল্টিডিসিপ্লিনারি সিস্টেমস (এইমস) ল্যাব। এই গবেষণাগারের তত্ত্বাবধানে আছেন সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার এ মামুন। তিনি জানালেন, উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে তাঁরা স্বাস্থ্য, শারীরিক অক্ষমতা ও শিক্ষাবিষয়ক নানা সমস্যার সমাধান খুঁজতে চেষ্টা করছেন। এরই মধ্যে এইমস ল্যাবের কিছু প্রকল্প পুরস্কারও পেয়েছে। খন্দকার এ মামুন বললেন, ‘শিক্ষার্থীদের আমরা ফলিত গবেষণায় আগ্রহী করতে চাই।’

শুধু প্রকৌশলের ক্ষেত্রেই নয়, বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদেরও গবেষণায় আগ্রহী করতে চায় ইউআইইউ। বিবিএর ডেপুটি ডিরেক্টর ও সহযোগী অধ্যাপক জেমস বকুল সরকার বললেন, ‘দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য আগামী মাসে আমরা একটা “রিসার্চ সিম্পোজিয়াম” (গবেষণা সম্মেলন) আয়োজন করছি। এরই মধ্যে ১৬৭টি গবেষণার ধারণা জমা পড়েছে। বাণিজ্য নিয়ে যাঁরা পড়েন, তাঁদের কিন্তু গবেষণার প্রচুর সুযোগ আছে। কিন্তু আমাদের দেশে এই চর্চা খুব একটা নেই।’

ইউআইইউ–এর পাঠাগার
ইউআইইউ–এর পাঠাগার

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টির বেশ কয়েকটি ইনস্টিটিউট রয়েছে। যেমন সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অব আইটি প্রফেশনালস (সিডিআইপি), ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনোমিক রিসার্চ, ভিএলএসআই ট্রেনিং একাডেমি, সিসকো নেটওয়ার্কিং একাডেমি ইত্যাদি। উপাচার্য এম রিজওয়ান খান অবশ্য এতেই সন্তুষ্ট নন। বললেন, ‘একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যত বেশি গবেষণা হওয়া উচিত, ততটা আমরা পারছি না। তবে দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে আমরা এগিয়ে আছি।’

জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রেও এগিয়ে আছেন ইউআইইউয়ের শিক্ষার্থীরা। ন্যাশনাল হ্যাকাথন, বিতর্ক উৎসব, রোবোটিকস প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন আয়োজন থেকে পুরস্কার এসেছে। ক্যাম্পাসে তাঁরা নিজেরাও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করছেন। এই তো কদিন আগেই নতুন উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে ইউআইইউয়ের বিজনেস ক্লাব আয়োজন করেছিল ‘মার্কেটিং সামুরাই’। শিক্ষার্থীদের মোট ১২টি ক্লাব ও ১২টি ফোরাম কার্যকর আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। জানা গেল, প্রতি সেমিস্টারের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী বৃত্তি পান। ৪ শতাংশ পান শতভাগ, ৬ শতাংশ পান ৫০ ভাগ, আর বাকি ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী ২৫ ভাগ বৃত্তি পান।

‘ফ্রেন্ড সার্কেল’ বলে কিছু নেই!

শিক্ষার্থীদের কয়েকটি সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে আড্ডায় বসেছিলাম আমরা। কথা বলতে বলতে হঠাৎ চমকে ওঠার মতো তথ্যটা দিলেন কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ফজলুল হক। বললেন, ‘আমাদের এখানে “ফ্রেন্ড সার্কেল” বলে কিছু নেই।’ বলে কী! বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ফ্রেন্ড সার্কেল’ না থাকে কী করে? বুঝিয়ে বললেন একই বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী মিফতাহুল জান্নাত, ‘সবার সঙ্গে সবার সম্পর্কটা এমন, আলাদা করে “ফ্রেন্ড সার্কেল” দরকার হয় না। সিনিয়র, জুনিয়র সবাই সবার বন্ধু। যখন যাঁদের সামনে পাচ্ছি, তাঁদের সঙ্গেই আড্ডা জমে যাচ্ছে।’

‘নতুন ক্যাম্পাসে যাচ্ছেন আপনারা, কেমন লাগছে?’ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সবাই একসঙ্গে কথা বলে উঠলেন। হইহুল্লোড়ের ভেতর থেকে যা পাওয়া গেল, তার মোদ্দাকথা এই—সবাই খুব খুশি। শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী সনেটের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে অবশ্য আফসোসও মিশে আছে। বলছিলেন, ‘এটাই আমার শেষ সেমিস্টার। নতুন ক্যাম্পাসে ক্লাস করা হলো না।’ ইউআইইউ ছেড়ে যাওয়ার পর ক্যাম্পাসের কী মিস করবেন? এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন বিবিএর ছাত্র আল আমিন শাহরিয়ার, ‘সবচেয়ে বেশি মিস করব ভার্সিটির অনুষ্ঠানগুলো। এখন যেমন বিভিন্ন প্রোগ্রাম আয়োজন করছি, বাজেট করছি...পেশাজীবনে গিয়েও হয়তো এসবই করতে হবে। কিন্তু এখানে এসব করছি আনন্দের জন্য। আর চাকরি তো হবে উপার্জনের জন্য।’

ফেরার পথে দেখা হলো ইউআইইউ ডিবেট ক্লাবের দুই সদস্য শাহীদা ফাতেমা ও সাজিয়া রুমানার সঙ্গে। ‘অরেঞ্জ আর্মি’ রহস্যের সমাধান পাওয়া গেল তাঁদের কাছে। বললেন, ‘আমাদের ইউনিভার্সিটির লোগোটা কমলা রঙের। বিতর্কে আমরা যারা ইউআইইউয়ের প্রতিনিধিত্ব করছি, তাঁদেরকেই আমরা বলছি অরেঞ্জ আর্মি।’ শুধু অরেঞ্জ আর্মিরাই নন, বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রায় সাড়ে ছয় হাজার শিক্ষার্থী, আদতে সবাই ইউআইইউয়ের প্রতিনিধিত্ব করছেন।

এম রিজওয়ান খান
এম রিজওয়ান খান
আমাদের স্নাতকদের বয়স খুব বেশি নয়। আট-নয় বছর হবে। এরই মধ্যে তাঁরা দেশে-বিদেশে ভালো অবস্থানে পৌঁছে গেছেন। অনেকে বলে, গ্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে আমরা খুব কৃপণ। আসলে তা নয়। যার যতটুকু নম্বর প্রাপ্য, সে ঠিক ততটুকুই পাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মকানুন, কার্যক্রমের ক্ষেত্রে আমরা একদম স্বচ্ছ। আমাদের উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনাও খুব পরিষ্কার—আমরা বাংলাদেশের এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয় হতে চাই।

এম রিজওয়ান খান
উপাচার্য, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি