জীবনের বাঁকে সিনেমা

নিউইয়র্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিসের সময় নির্মিত ছবির শুটিংয়ে রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত। ছবি: সংগৃহীত
নিউইয়র্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিসের সময় নির্মিত ছবির শুটিংয়ে রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত। ছবি: সংগৃহীত

খুব সহজ করে খবরটা এভাবেও বলা যেত, যুক্তরাষ্ট্রের স্লোন ফাউন্ডেশন থেকে ছবি বানানোর জন্য এক লাখ ডলার অর্থাৎ প্রায় ৮৪ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছেন বাংলাদেশের ছেলে রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত। কিন্তু এর আগে স্লোন ফাউন্ডেশন কোন কোন ছবিকে অনুদান দিয়েছে, সে সম্পর্কে একটুখানি না বললেই নয়। অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র দ্য ইমিটেশন গেম, গোল্ডেন গ্লোবজয়ী দ্য মারশিয়ান হিডেন ফিগারস, দ্য ডাইভিং বেল অ্যান্ড দ্য বাটারফ্লাইসহ অনেকগুলো ছবিই হয়তো আপনার কাছে পরিচিত ঠেকবে। এমনই স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের অনুদান পেয়েছেন আমাদের সুমিত। নোনাজলের কাব্য নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির শুটিং করতে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন তিনি। আর স্লোন ফাউন্ডেশনের অনুদান পেয়েছেন আ নিউ প্রফেট নামে আরেকটি ছবির জন্য। পাঠক, ছবি দুটির নাম মনে রাখুন। এ প্রসঙ্গে পরে ফিরছি। আগে সুমিতের নির্মাতা হয়ে ওঠার গল্পটা জানা যাক।

আইবিএ থেকে সিনেমায়

নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি টিস স্কুল অব দ্য আর্টস থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করা এই চলচ্চিত্রনির্মাতা স্নাতক সম্পন্ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে। তাহলে সিনেমায় কীভাবে? ‘আর্ট কালচার থেকে আমাদের পড়াশোনা বেশ দূরে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ব্যবধান মাত্র একটি দেয়াল। দেয়ালের এপাশে আমরা ওপাশে চারুকলা।’ বলেন সুমিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি অনুষদের মধ্যে দেয়াল থাকলেও ভাবনার জগতে তো আর দেয়াল নেই। ছোটবেলা থেকে তাই বই পড়ে, সিনেমা দেখে তাঁর শিল্পীমন গড়ে উঠেছিল। তবে তখন ভাবেননি চলচ্চিত্রনির্মাতা হবেন। বলছিলেন, ‘আইবিএতে ভর্তি হওয়ার পর ক্লাস শেষ করে চারুকলায় গিয়ে সময় কাটাতাম। মনে হতো অন্য একটা জগতে চলে এসেছি, যেখানে সবাই সৃষ্টিকর্মে মত্ত। তো সেখানেই দেখলাম একটা “ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্স”–এর পোস্টার। ভর্তি হয়ে গেলাম। কোর্সের পরই মাথায় ঢুকে গেল সিনেমার পোকা।’ সিনেমার গল্পের মতো সুমিতের জীবনের গল্পেও বাঁক বদল হলো এই সময়টাতে।

আইবিএতে পড়ার সময় নির্মাণ করেছিলেন ‘সিটি লাইফ’ নামে একটি ডকু-ফিকশন। যার বদৌলতে ডাক পান বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের বার্লিনেল ট্যালেন্ট ক্যাম্পাসে। যদি ভাবেন এরপর থেকেই তিনি পুরোদমে সিনেমায় মন দিয়েছেন, ভুল হবে। কারণ, স্নাতক শেষ করার পর প্রায় তিন বছর চাকরি করেছেন তিনি।

সুমিত বলছিলেন, ‘আমি চেষ্টা করেছি সিনেমার আশপাশে থাকার। যেমন শেষ বর্ষে সবাই ইন্টার্নি করে বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানে। আমি ইন্টার্নি করেছি একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। চাকরি করেছি আরেকটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। বহুজাতিক কোম্পানিতে মার্কেটিং সেকশনে কাজ করেছি যেন সিনেমা বা এর আশপাশে থাকা যায়।’ জানালেন, চাকরির পাশাপাশি সেই সময়ই বাসায় বসে দুই বছর একা খেটে বানিয়েছেন অ্যানিমেশন ছবি মুন ফেইরি। যার স্ক্রিনিং হয়েছিল কোপেনহেগেন চিলড্রেন্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। এরপরই সিনেমার ভূত সুমিতের ঘাড়ে আরও শক্ত করে চেপে বসে!

পড়াশোনার বাঁকবদল

সিনেমার টানে চাকরিটা আর ভালো লাগছিল না। সুমিতের আগ্রহ—সিনেমা নিয়ে পড়বেন। এদিকে মা-বাবার চাওয়া—ছেলে এমবিএ করুক। সুমিত বলেন, ‘মা-বাবা রাজি হলো এক শর্তে। সিনেমা এবং এমবিএ—দুটির জন্যই অ্যাপ্লাই করতে হবে। যেখানে সুযোগ হবে সেটাতেই ভর্তি হতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি টিস স্কুল অব দ্য আর্টসে স্কলারশিপ পেলাম।’ এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি, হলিউড রিপোর্টারের সর্বশেষ র‍্যাঙ্কিং অনুযায়ী সিনেমা স্কুলগুলোর তালিকায় টিস স্কুল অব আর্টসের অবস্থান দুই। চলচ্চিত্র পরিচালক চার্লি কফম্যান, মার্টিন স্করসিসে থেকে শুরু করে অভিনেতা জেমস ফ্র্যাঙ্কো, গায়িকা লেডি গাগাসহ অনেকেই এখানে পড়েছেন।

নিউইয়র্কের পথে পথে

টিস স্কুল অব দ্য আর্টসের ওয়েবসাইটে গিয়ে সুমিতের নামের পাশে যে কাজের তালিকা দেখা যাচ্ছে, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি চারটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি প্রযোজনা করেছেন। পরিচালনা করেছেন তিনটি। এ ছাড়া দুটি ছবির রচনা, তিনটির সম্পাদনা, পাঁচটির শব্দ সংমিশ্রণ, তিনটি ছবির গ্রাফিক ডিজাইনসহ নানা ধরনের কাজে জড়িত ছিলেন। তিন বছরের স্নাতকোত্তরের ফাঁকে এত কাজ করার সুযোগ হলো কী করে? সুমিতের উত্তর, ‘প্রতি সেমিস্টারেই একটি করে সিনেমা বানাতে হতো।’

চাকরি ছেড়ে নিজের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে তাঁকে। বলছিলেন, ‘নিউইয়র্কে চলার জন্য মানুষ বিভিন্ন ধরনের কাজ করে। আমি সিনেমায় ফ্রিল্যান্স করা শুরু করলাম। কাজটা কঠিন ছিল। কারণ আমাকে কেউ চেনে না। কে কাজ দেবে? কষ্ট হয়েছে কিন্তু পেরেছি।’ জানালেন, এই চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গত বছর স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন তিনি।

নোনাজলের কাব্য ও আ নিউ প্রফেট

নিউইয়র্কে থাকার সময় সুমিত ‘স্পাইক লি রাইটিং গ্র্যান্ড’–এর জন্য নোনাজলের কাব্য ছবির গল্প জমা দিয়েছিলেন। পেয়েও গেছেন। জানালেন, তাঁর এই ছবিটির প্রযোজক জিজি ডেমেন্ট, যাঁর প্রযোজিত স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি গড অব লাভ ২০১০ সালে অস্কার পেয়েছিল। তাঁর সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ হলো? ‘আমার ক্যাম্পাসের সিনিয়র তিনি। তাই “স্পাইক লি রাইটিং গ্র্যান্ট” পাওয়ার পর তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। তিনি গল্প পড়ে কাজ করতে আগ্রহী হন।’ বলেন সুমিত। ‘এরপর নোনাজলের কাব্যর আরেক প্রযোজক পাওয়ার জন্য ভারতের গোয়ায় এনএফডিসির আয়োজনে ফিল্মবাজারে আমন্ত্রিত হই। নতুন নির্মাতা এবং প্রযোজকদের মিলনমেলা বসে এখানে। সেখানে পেয়ে যাই ফরাসি প্রযোজক ইলান জিরাদকে। আমার সিনেমার গল্প পড়ে তিনিও সম্প্রতি কাজ করতে আগ্রহী হন।’ জানালেন, ইলান জিরাদও অস্কারজয়ী তথ্যচিত্র মার্চ অব দ্য পেনগুইনস এর প্রযোজক।

আর আ নিউ প্রফেট? বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই এই সিনেমার গল্প জমা দিয়েছিলেন স্লোন ফাউন্ডেশনকে অনুদানের জন্য।

ফাউন্ডেশনটি যুক্তরাষ্ট্রের যে ছয়টি স্কুলের সঙ্গে কাজ করে, তার একটি হলো টিস স্কুল অব আর্টস। প্রথমে রাইটিং গ্র্যান্ড, তারপর নির্মাণের জন্য অনুদানও পেয়েছেন তিনি। সুমিত বলেন, ‘রাইটিং গ্র্যান্ড পাওয়ার পর চিত্রনাট্য তৈরি করা, তারপর বিজ্ঞানীদের সঙ্গে বসা, বাজেট তৈরি করা, ওদের শর্তগুলো পূরণ করা...কাজটা সহজ ছিল না।’ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে বসতে হলো কেন? বিষয়টা পরিষ্কার করলেন তিনি, ‘স্লোন ফাউন্ডেশন সাধারণত বিজ্ঞাননির্ভর সিনেমাকে অনুদান দেয়।’ তাহলে আ নিউ প্রফেট কি সায়েন্স ফিকশন? তরুণ এই চিত্রনির্মাতা বললেন, ‘না। তবে বিজ্ঞাননির্ভর গল্প বলা যায়।’

এখন নোনাজলের কাব্য নিয়ে ব্যস্ত রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত। এরপর আ নিউ প্রফেট–এর কাজ শুরু হবে। তাঁর বানানো চলচ্চিত্র দেখতে হলে দর্শককে অপেক্ষায় থাকতে হবে আরও কিছুদিন। দর্শককে অপেক্ষায় থাকতে হবে আরও কিছুদিন।