ক্যাম্পাসে এসে খাই ভালোবেসে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ২০ টাকায় মেলে দুপুরের খাবার। স্বপ্ন নিয়ের আয়োজনে মডেল হয়েছেন জেনিফার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ২০ টাকায় মেলে দুপুরের খাবার। স্বপ্ন নিয়ের আয়োজনে মডেল হয়েছেন জেনিফার


খাবারের নাম ‘সিস্টেম’!

খাবার হোটেলে ঢুকে যদি কেউ ‘সিস্টেম দাও’ বলে হাঁক ছাড়েন, বেয়ারা নিশ্চয়ই হাঁ করে তাকিয়ে থাকবেন। ব্যতিক্রম—রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। এখানে স্টেশনবাজারের একটি হোটেলে ‘সিস্টেম দাও’ বললেই মিলবে ছয় পদের খাবার। দাম মাত্র ২০ টাকা। দামে কম বলে একে অবহেলা করার সুযোগ নেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ‘সিস্টেম’ বেশ জনপ্রিয়। সিস্টেমের আসল নাম আদতে ‘সিক্স আইটেম’। মুখে মুখে ডাকনাম হয়ে গেছে সিস্টেম।

সিস্টেম পাওয়া যাবে স্টেশন বাজারের হোটেল মাদারীপুরে। এই খাবারের জনক মানিক মিঞা। তাঁর হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ২০ বছর ধরে হোটেল মাদারীপুরে সিস্টেম চালু আছে। আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে সিস্টেম মিলত মাত্র ৬ টাকায়। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে ৬ টাকা থেকে বেড়ে ২০ টাকা হয়েছে। ছয় পদের খাবারের মধ্যে রয়েছে দেড় প্লেট ভাত, অর্ধেক ডিম, বেগুনভাজি, আলুভর্তা, শিমভর্তা ও আলুভাজি। ডাল অবশ্য সবার জন্য ফ্রি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাফিস অলি তিন বছর ধরে সিস্টেম খাচ্ছেন। তাঁর ভাষায়, ‘হলের খাবারে একঘেয়েমি আছে। কিন্তু সিস্টেমে তা নেই। মৌসুম বদল হলে এখানে খাবারেও একটু পরিবর্তন আসে।’

মানিক মিঞা প্রতিদিন ৪০০ সিস্টেম তৈরি করেন। ‘আগে এলে আগে পাবেন’ ভিত্তিতে খাবার ফুরিয়ে যায় দ্রুত।

আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

খিচুড়ি আর আড্ডা

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের পছন্দের খাবারের তালিকায় সবার ওপরে জায়গা পাবে সম্ভবত খিচুড়ি। শিক্ষা ভবন ‘সি’, ‘বি’ ও ‘ই’-এর পাশে আছে বেশ কয়েকটি টং দোকান। গত বুধবার ‘বি’ ভবনের টংয়ে বসে খিচুড়ি খাচ্ছিলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শুভ্র গোপ, দীপিকা দেবনাথ, সুলতানা বেগম, সানিয়েল মিয়া ও বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের নুরুল হাসান। তাঁরা জানালেন, এই খিচুড়ি তাঁদের ক্যাম্পাসজীবনের অংশ হয়ে গেছে। সকালে ক্লাসের আগে কিংবা দুপুরে বিরতির সময় দল বেঁধে চলে আসেন গরম-গরম খিচুড়ি খেতে। কোনো কারণে এক দিন খাওয়া না হলে নাকি মনে হয়, ‘আজ কী যেন মিস হয়ে গেছে!’

প্রায় ২০ বছর ধরে ক্যাম্পাসে খিচুড়ি বিক্রি করেন মাসুক আহমদ। সবার কাছে তিনি মাসুক মামা নামে পরিচিত। বললেন, ‘বিশ বছর আগে যখন শুরু করেছিলাম, তখন প্রতি প্লেটের দাম ছিল ৫ টাকা। এখন দাম ১৫ টাকায় উঠেছে। কিন্তু চাহিদা একটুও কমেনি, বরং বেড়েছে।’ ক্যাম্পাসে কোনো উৎসব কিংবা বড় আয়োজনেও ডাক পড়ে কবির মামা ও মাসুক মামাদের। কম খরচে সুস্বাদু খিচুড়ি তৈরি করতে তাঁদের কোনো জুড়ি নেই।

মিসবাহ্ উদ্দিন

২০ টাকায় কেনা সুখ

রাশেদ খান তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগে মাত্রই ভর্তি হয়েছেন। ক্যাম্পাসের আনাচকানাচ তখনো সেভাবে চেনা হয়নি। এরই মধ্যে একদিন এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে খেতে বসেছিলেন টিএসসির ক্যাফেটেরিয়ায়। পাতে ছিল ভাত, ডাল, আলুভর্তা আর মুরগির মাংস। দাম? ২০ টাকা! রাশেদের জন্য আরও চমক অপেক্ষা করছিল। খাবারের মাঝে পানি খেতে চেয়েছিলেন তিনি। আর বড় ভাই ফিরেছেন দুই বাটি ডাল নিয়ে! এখানে ভাত আর ডাল ‘আনলিমিটেড’, যত খুশি খাও। রসিকতা করে সেদিন বড় ভাই বলেছিলেন, ‘জানো তো, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলে সেটি হবে পানির জন্য। আমরা তাই আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। বেশি করে ডাল খাও, পানির ওপর চাপ কমাও!’

এমন কত ঠাট্টা, রসিকতা, হাসি-কান্নার গল্প জমে আছে টিএসসির এই ২০ টাকার খাবারের সঙ্গে। ক্যাম্পাসের বাইরের কেউ হয়তো এর আবেগ বুঝবেন না। হলে থেকে, টিউশনি করে যার পড়ালেখার খরচ জোটাতে হচ্ছে; যে শিক্ষার্থীর স্বপ্নগুলো একটু একটু করে ডানা মেলছে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে, তাঁকে জিজ্ঞেস করুন। জানবেন, ২০ টাকায় কেনা এই ‘সুখ’ তাঁর কাছে অমূল্য।

সব সময় যে ভাত রান্না হয়, তা নয়। মাঝেমধ্যে ২০ টাকায় পোলাও আর মুরগির মাংসও পাওয়া যায়। আর আছে ১ টাকার চা। রং চায়ের ধোঁয়ায় আড্ডাগুলো ছড়ায় কত রং! সাবেক শিক্ষার্থীরা এখনো অনেকে চলে আসেন। শুধু খাবারের স্বাদ নয়, স্মৃতির স্বাদের খোঁজে!

সঞ্জয় সরকার

টক-ঝাল আড্ডায় চিকেন আচারি

‘কী খাব?’ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ক্যানটিনে পা রেখে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা কঠিন। শিঙাড়া, ডিমচপ, ভাত-ভর্তা, তেহারি থেকে শুরু করে ফ্রাইড রাইস, ফ্রাইড চিকেনও পাওয়া যায় এখানে। এত খাবারের মধ্যে শিক্ষার্থীদের পছন্দের খাবার কোনটা, এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে রীতিমতো জরিপ করতে হবে। তবে যে খাবারটা শিক্ষার্থীদের চোখে একটু আলাদা, সেটা হলো চিকেন আচারি আর পরোটা। দাম ৮০ টাকা।

কেউ হয়তো চিকেন আচারি-পরোটা খেয়ে মিড টার্ম পরীক্ষার জন্য শক্তি সঞ্চয় করেন, কেউ আবার পরীক্ষা ভালো না হওয়ার দুঃখ ভোলেন এর টক-ঝাল স্বাদে। খেতে খেতে আড্ডা তো জমেই।

বিবিএর ছাত্রী সুস্মিতা সামাদ বলছিলেন, ‘সকাল আটটায় ক্লাস থাকলে অনেক সময় বাসা থেকে না খেয়েই বেরোতে হয়। তখন ক্যানটিনের খাবারের মধ্যে আমার প্রথম পছন্দ থাকে চিকেন আচারি আর পরোটা।’ মজা করে বিবিএর আরেক ছাত্র মিনহাজ রেমো বললেন, ‘মাঝেমধ্যে আয়েশ করে চিকেন আচারি খেতে গিয়ে আমার ক্লাসের দেরি হয়ে যায়।’

সৌরীন রহমান

ভর্তায় ভরি পেট

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে খাওয়ার জায়গা মানে এককথায়—বটতলা। আর বটতলা মানেই তো ভর্তা। অনেক বছর আগে বটগাছের নিচে তিনটা দোকান দিয়ে বটতলার যাত্রা শুরু হয়েছিল। এখন বটতলার এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত হেঁটে যেতে মিনিট দশেক সময় লাগে। বটতলায় গেলেই চোখে পড়ে সারি সারি খাবারের দোকান। প্রতিটি দোকানের সামনে সাজানো হরেক পদের ভর্তা। কী নেই সেখানে! আলুভর্তা-বেগুনভর্তা তো আছেই। সঙ্গে শিম, টমেটো, কাঁচকলা, রসুন, ধনিয়া, সরিষা, কয়েক ধরনের মাছ, শুঁটকিভর্তা থেকে শুরু করে কালোজিরা, বাদাম এমনকি মুরগির মাংসের ভর্তাও পাওয়া যায়! দাম ৫ থেকে ১০ টাকা।

স্বাদে ভালো আর দামে কম হওয়ায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী ভর্তা খেয়েই পেট ভরেন। ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ছাত্র আশরাফুল আলম বলছিলেন, ‘ভাতের সঙ্গে ভর্তা হলে আর কিছু লাগে না। বিশেষ করে মাসের শেষে নানা রকম ভর্তাই থাকে আমার খাবারের তালিকায়। কম খরচে এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে!’

ভর্তার খ্যাতিরও নাকি বিড়ম্বনা আছে! সাইমুম মৌসুমী পড়ছেন অর্থনীতি বিভাগে। একটু বিরক্তি নিয়েই বললেন, ‘আমাদের এখানে ভর্তা ভালো, ফেসবুকের মাধ্যমে এই খবর সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। ভর্তা খেতে এসে অনেক সময় বহিরাগতরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট করে। অতিথি এলে আমরা অখুশি হই না। কিন্তু অতিথিদের মনে রাখা উচিত, এটা স্রেফ রেস্তোরাঁ নয়, একটা ক্যাম্পাস। গাড়ি নিয়ে এসে এখানে হইচই-চেঁচামেচি করাটা ঠিক না।’

সাহিব নিহাল