অক্সফোর্ড ছাত্র সংসদের প্রেসিডেন্ট আনিশা

আনিশা ফারুক
আনিশা ফারুক

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছে স্বপ্নের ক্যাম্পাস। এখানকার ছাত্রছাত্রীদের ভোটে তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হওয়া নিশ্চয়ই স্বপ্নের মতো একটা অর্জন। সেই অর্জন দিয়েই তাক লাগিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আনিশা ফারুক।

আনিশা অক্সফোর্ডের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ‘অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট ইউনিয়ন’-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ৭ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে প্রথম কোনো বাংলাদেশি হিসেবে এই পদে আসীন হলেন আনিশা।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা যুক্তরাজ্যে। পড়ার বিষয় ইতিহাস। স্নাতক তৃতীয় বর্ষের এই ছাত্রীর বাবা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর ফারুক আহমেদ। মা রেহানা চৌধুরী। জিবরান ফারুক নামে তাঁর এক ছোট ভাই আছে। সে এ লেভেল পড়ছে। লন্ডনের ওয়েম্বলি এলাকায় এই পরিবারের বসবাস। বাংলাদেশে তাঁদের বাড়ি ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলায়।

‘বাবা আমি জিতে গেছি’
স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার রাত প্রায় ৯টা। আনিশা ফোন করে জানালেন, ‘বাবা, আমি জিতে গেছি।’ বিশ্বাস হচ্ছিল না বাবা ফারুক আহমেদের। ‘তুমি কি আমার সঙ্গে মজা করছ’, বলেছিলেন তিনি। আনিশা নিশ্চিত করেন, ‘সত্যি বলছি বাবা।’

গর্বিত বাবা এভাবেই জানালেন মেয়ের অর্জনের কথা। আর আনিশা স্বপ্ন নিয়েকে জানালেন, নির্বাচনটি তাঁর জন্য ছিল বিশাল চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, ‘নিজের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্যই এই লড়াইয়ে নেমেছিলাম। যদি আমার অর্জন কারও জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকে, সেটা বাড়তি পাওয়া।’

ছাত্র সংসদ ও নির্বাচন
প্রেসিডেন্ট এবং বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত চারজন ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ছাত্র সংসদ স্টুডেন্ট ইউনিয়ন শীর্ষ কমিটি। আছে তিনজন স্টুডেন্ট ট্রাস্টি এবং ছয়জন ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব স্টুডেন্টস প্রতিনিধি। প্রতি দুই বছর পরপর নির্বাচন হয়। কয়েক ধাপে হয় ভোট। প্রতি ধাপে সর্বনিম্ন ভোট পাওয়া প্রার্থী বাদ পড়েন। প্রেসিডেন্ট পদে শীর্ষ তিনে আনিশার সঙ্গে ছিলেন এলি মিল-ব্রাউন ও ইভি ম্যানিং। চূড়ান্ত ধাপের ভোটাভুটিতে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫২৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন আনিশা। ৪ হাজার ৭৯২ জন ভোটার বিভিন্ন ধাপে মোট ২৮ হাজার ৮২৩ ভোট দিয়েছেন। ২০১৯-২০ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করবেন আমাদের বাঙালিকন্যা আনিশা।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে দর–কষাকষি করাই স্টুডেন্ট ইউনিয়নের আসল কাজ। এর পাশাপাশি সেমিনার, বিতর্ক, সাংস্কৃতিক কর্মশালা আয়োজনের পাশাপাশি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নে ভূমিকা রাখে এই সংগঠন।

নির্বাচনে আনিশার অন্যতম প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রিডিং উইক’ বা বই পড়া সপ্তাহ চালু করা, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও চাকরির সমন্বয় করতে ‘ফ্রি আওয়ার ওয়েডনেস ডে’ বা বুধবারকে ছুটির দিন ঘোষণা করতে কাজ করা এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আরও যত্নবান করা।

প্রসঙ্গত, স্টুডেন্ট ইউনিয়নে নির্বাচিতরা চাইলে দায়িত্ব পালনের প্রয়োজনে পড়াশোনা স্থগিত রাখতে পারেন। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মোটা অঙ্কের বেতনও পেয়ে থাকেন। এখানে প্রেসিডেন্টের বেতন বাংলাদেশি টাকায় বছরে প্রায় ২২ লাখ টাকা। তবে আনিশা দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি পড়াশোনাও অব্যাহত রাখতে চান।

পড়াশোনা-নেতৃত্ব সমানতালে
ওয়েম্বলি হাইটেকনোলজি কলেজে জিসিএসই এবং এ লেভেল পড়েন আনিশা। বিদ্যালয়ে তিনি ছিলেন ক্লাসের ‘হেড গার্ল’। পড়াশোনায় ছিলেন তুখোড়। ছিলেন ভালো বিতার্কিক। এ লেভেলে ইয়ুথ পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। জিসিএসইতে মোট ২০টি বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে ১৪টিতেই এ স্টার পেয়েছেন। ৬টিতে পেয়েছেন এ। এ লেভেল পরীক্ষায় ভালো করার শর্তে ওই সময় অক্সফোর্ড থেকে ভর্তির ডাক আসে। সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ২০১৬ সালে ভর্তি হন অক্সফোর্ডে।

বাংলাদেশে চিকিৎসাবিদ্যা কিংবা প্রকৌশল নিয়ে পড়া যতটা গৌরবের, যুক্তরাজ্যে ইতিহাস কিংবা সমাজবিদ্যা নিয়ে পড়া তাঁর চেয়েও বেশি গৌরবের। কেননা এসব বিষয়ে পড়া শিক্ষার্থীরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেশ ও জাতিকে নেতৃত্ব দেন। আনিশাও সেই নেতৃত্বের পথে হাঁটলেন। ছোটবেলার চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন পেছনে ফেলে ভর্তি হলেন ইতিহাস বিভাগে। নিজেকে একের পর এক সাংগঠনিক কাজে যুক্ত করেন তিনি। যোগ দেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় শাখা লেবার ক্লাবে (লেবার দলের আদর্শে বিশ্বাসী শিক্ষার্থীদের সংগঠন)। শুরুতে প্রচার কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে সংগঠনটির কো-চেয়ার নির্বাচিত হন। স্টুডেন্টস ইউনিয়নের স্কুটিনি কমিটির সদস্য ছিলেন। বিশ্বের সেরা ডিবেট সোসাইটি ‘অক্সফোর্ড ইউনিয়ন’–এর স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা ‘অক্সফোর্ড স্টুডেন্ট’–এর প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর রাজনৈতিক ও দাতব্যকাজের পরিধিও বেশ বড়। আনিশা বলেন, দেশ ও মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করাই তাঁর লক্ষ্য। সক্রিয় রাজনীতির মাধ্যমে কাজটি বেশি সহজ বলে মন্তব্য তাঁর।

আনিশার আত্মবিশ্বাস
নির্বাচনের আগে স্টুডেন্ট ইউনিয়নের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরাসরি এক বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বিতর্কে আনিশা বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কাজ করার কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘স্টুডেন্ট ইউনিয়নকে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে আমিই সেরা। আমার চেয়ে ভালো কোনো প্রার্থী থাকলে আমি প্রার্থীই হতাম না।’ এমন সাহসী বক্তব্যের রহস্য কী? আনিশার জবাব, ‘বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতাই আমার এমন সাহসের ভিত গড়ে দিয়েছে।’

তরুণদের উদ্দেশে আনিশা বলেন, ‘শিক্ষাকে কাজে লাগাতে পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সাংগঠনিক ও দাতব্যকাজে যুক্ত হওয়া জরুরি।’

আর আনিশার বাবা বলেন, ‘আনিশার যত অর্জন, সবটুকুই নিজ তাগিদে। আমরা কেবল উৎসাহ দিয়েছি।’ আনিশা ছোটবেলা থেকেই পাঠ্যপুস্তকের বাইরে প্রচুর বই পড়েছে বলে জানান তিনি।

>

একনজরে অক্সফোর্ড

ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলোতে অক্সফোর্ড প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় এটি দ্বিতীয়। পড়ালেখা, শিক্ষকতা, গবেষণা—সবকিছুর জন্যই এটি পৃথিবীর অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান। ২৭ জন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর জন্ম দিয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতা হয়েছেন আরও ৩০ জন। নানা খাতে যুগান্তকারী অবদানের সেরা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের মধ্যে ৫০ জন অক্সফোর্ডপড়ুয়া। আর ক্রীড়ার শীর্ষ আন্তর্জাতিক আসর অলিম্পিক মেডেল বিজয়ীদের মধ্যে অক্সফোর্ডের শিক্ষার্থী আছেন ১২০ জন।

৩৫০টি বিষয়ে এখানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়ানো হয়। ১৫০টি দেশ ও অঞ্চলের শিক্ষার্থী মিলিয়ে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ২৪ হাজার। যাঁদের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার (৪৩ শতাংশ) বিদেশি শিক্ষার্থী। শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্থানীয় অর্থনীতিতে এর অবদান বছরে প্রায় ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন পাউন্ড। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে এসব তথ্য দেওয়া আছে।