আচরণবিধি ভেঙে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন 'যে যার মতো'

ড্রাম বাজিয়ে ক্যাম্পাসে প্রচারণা চালায় প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্য। ছবি: প্রথম আলো
ড্রাম বাজিয়ে ক্যাম্পাসে প্রচারণা চালায় প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্য। ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের আচরণবিধি মানছেন না কোনো প্যানেলের প্রার্থীরাই৷ ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, বামপন্থী ছাত্রসংগঠন ও সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদসহ কোনো কোনো স্বতন্ত্র প্যানেলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধেও উঠেছে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ৷ আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ক্যাম্পাসের বিভিন্ন এলাকায় প্রচারণাকালে তাঁরা নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন৷

ডাকসু নির্বাচনের আচরণবিধির ৩(ক) ধারায় বলা হয়েছে, ‘নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো ধরনের যানবাহন যেমন-মোটরকার, মোটরসাইকেল, রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি, হাতি, ব্যান্ড পার্টি ইত্যাদি নিয়ে কোনোরূপ শোভাযাত্রা বা মিছিল করা যাবে না৷’ আচরণবিধির ৪(গ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের ভোটার বা প্রার্থী ছাড়া অন্য কেউ কোনোভাবেই কোনো প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রচারণা চালাতে পারবেন না।’

অবশ্য যাঁরা আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন তাঁরা আচরণবিধির ব্যাখ্যা দিচ্ছেন নিজের মতো করে।

আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টার কিছু আগে ক্যাম্পাসে ‘ব্যান্ড পার্টিসহ’ শোভাযাত্রা বের করেন বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর দুই মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্রঐক্য সমর্থিত যৌথ প্যানেল প্রগতিশীল ছাত্রঐক্যের প্রার্থীরা ৷ শোভাযাত্রায় জোটের কেন্দ্রীয় নেতারাও ছিলেন, যাঁরা ডাকসুর ভোটার বা প্রার্থী কোনোটাই নন।

জানতে চাইলে বামজোট থেকে ডাকসুর সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী ও ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী বলেন, ‘আমরা গানের মিছিল করেছি এবং শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। এটা ব্যান্ড পার্টি ছিল না।’ শোভাযাত্রায় জোটের কেন্দ্রীয় নেতা ও ডাকসুর ভোটার বা প্রার্থী নন, এমন নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণের বিষয়ে লিটন বলেন, তাঁদের কেন্দ্রীয় নেতারা যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদের সদস্য, প্রচারণায় তাঁরা থাকতেই পারেন। এ বিষয়ে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলবেন।

দুপুরে কলাভবনের সামনে ভোটারদের লিফলেট দিচ্ছিলেন ডাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্যানেলের প্রার্থীরা। সেখানে ছিলেন প্যানেলটির ভিপি প্রার্থী নুরুল হক নুর, জিএস প্রার্থী রাশেদ খান, এজিএস প্রার্থী ফারুক হোসেনসহ অন্যরা। তাঁদের প্রচারণায় সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুনকেও দেখা যায়। হাসান আল মামুন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। বর্তমানে তিনি কোথাও ভর্তি নেই। এই মুহূর্তে তিনি ডাকসুর ভোটার বা প্রার্থী কোনোটিই নন।

বহিরাগত ও অছাত্রদের নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রচারে ছাত্রলীগ। ছবি: প্রথম আলো
বহিরাগত ও অছাত্রদের নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রচারে ছাত্রলীগ। ছবি: প্রথম আলো

জানতে চাইলে হাসান আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আমাদের সংগঠনের প্যানেলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান। সেই হিসেবে আমি প্রচারণায় থাকতেই পারি। ছাত্রলীগের ভিপি ও জিএস প্রার্থী যাঁদের নিয়ে প্রচারণা করছেন, তাঁরা আমার চেয়ে চার-পাঁচ বছরের সিনিয়র।’

আজ সকাল থেকেই ক্যাম্পাসের বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে দেখা যায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের। প্রচারণায় ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান, ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার, সাধারণ সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী অংশ নেন। ছাত্রদলের এই তিন নেতা ছাত্রত্ব না থাকা ও বয়স ৩০-এর বেশি হওয়ায় ডাকসুর ভোটার বা প্রার্থী কোনোটিই নন। তাঁরা তিনজন ছাড়াও প্রচারণায় ছাত্রত্ব না থাকা ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী অংশ নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, মধুর ক্যানটিন, হাকিম চত্বরসহ বিভিন্ন এলাকায় তাঁরা ভোটারদের কাছে নিজেদের দলীয় প্যানেলের পক্ষে ভোট চেয়ে লিফলেট বিতরণ করেন।

জানতে চাইলে ছাত্রদল থেকে ডাকসুর জিএস প্রার্থী আনিসুর রহমান খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে আমাদের সিনিয়র নেতারা ক্যাম্পাসে এসেছিলেন। প্রচারণা চালানোর উদ্দেশ্যে তাঁরা ক্যাম্পাসে যাননি। ছাত্রলীগের শেল্টারে অনেক অছাত্র হলে থাকছে এবং প্রচারণায় অংশ নিচ্ছে।’

বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনের সামনে প্রচারণা চালাতে দেখা যায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও ছাত্রলীগের প্যানেল ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী সংসদ’ থেকে ডাকসুর ভিপি প্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে। প্রচারণায় শোভনের সঙ্গে কয়েকজন অছাত্র ও বহিরাগত ছিলেন। তবে জানতে চাইলে শোভন অভিযোগটি অস্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেন, তাঁর সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সবাই ডাকসুর ভোটার। এর আগে টিএসসি, মধুর ক্যানটিন, আবাসিক হলগুলোসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন এলাকায় রঙিন ছবিসহ লিফলেট লাগিয়ে ডাকসু নির্বাচনের আচরণবিধি ভঙ্গ করে আলোচনায় এসেছিলেন শোভন। রঙিন ছবিসহ সেই লিফলেটগুলো এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনার দেয়ালগুলোতে শোভা পাচ্ছে। শোভন তখন বলেছিলেন, তিনি জানেন না, তাঁর পক্ষে কে বা কারা লিফলেট লাগিয়েছে।

অছাত্র ছাত্রদলের নেতারা নিজ প্যানেলের পক্ষে প্রচার চালায়। ছবি: প্রথম আলো
অছাত্র ছাত্রদলের নেতারা নিজ প্যানেলের পক্ষে প্রচার চালায়। ছবি: প্রথম আলো

সংগঠনের প্যানেলের বাইরে থাকা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কারও কারও বিরুদ্ধেও উঠেছে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল সংসদে ছাত্রলীগ প্যানেলের প্রার্থীদের লিফলেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি রয়েছে। হলটিতে ‘রোকেয়া পরিষদ’ নামের স্বতন্ত্র একটি প্যানেলের লিফলেটে বেগম রোকেয়ার ছবি রয়েছে। কিন্তু ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের আচরণবিধির ৬(ক) ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো প্রার্থী নিজের সাদাকালো ছবি ছাড়া অন্য কারও ছবি বা প্রতীক লিফলেট বা হ্যান্ডবিলে ব্যবহার করতে পারবেন না।

আচরণবিধি লঙ্ঘনের শাস্তি হিসেবে ডাকসু নির্বাচনের আচরণবিধির ১৫(খ) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থী বা তাঁর পক্ষে অন্য কেউ নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা, প্রার্থিতা বাতিল অথবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার অথবা রাষ্ট্র বা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী অন্য যেকোনো দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।