পঞ্চাশেও উদীচীর দীপ্ত পথচলা

উদীচীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও সুবর্ণজয়ন্তীতে পদার্পণ উপলক্ষে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। গতকাল গণগ্রন্থাগার চত্বরে l প্রথম আলো
উদীচীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও সুবর্ণজয়ন্তীতে পদার্পণ উপলক্ষে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। গতকাল গণগ্রন্থাগার চত্বরে l প্রথম আলো

‘মানুষের কাছে পেয়েছি যে বাণী তাই দিয়ে রচি গান, মানুষের লাগি ঢেলে দিয়ে যাব মানুষের দেয়া প্রাণ।’ সত্যেন সেনের লেখা গানের চরণগুলো স্মরণ করলেন কামাল লোহানী। তাঁর বক্তব্যের বেশ খানিক আগে গণগ্রন্থাগার চত্বরে পরিবেশিত দলীয় সংগীতের কথাগুলো এমন, ‘সত্যেন রণেশের আঁকা পদচিহ্ন, লাল খামে বাঙালির ঠিকানা অভিন্ন, কানাগলি রাজপথ মেশে সেই মোহনায়, অন্য পথের দিশা চাই না’—এসব গানে খুব সহজেই মেলে সংস্কৃতিচর্চায় জড়িয়ে থাকা অর্ধশত বছরের পথে থাকা একটি সংগঠনের পরিচয়। এ সংগঠনের নাম উদীচী।
১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর জন্ম নেয় প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। যেখানে প্রতিদিনই নতুন নতুন সংগঠন জন্ম নিয়ে আবার কিছুদিন পরই তা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে, সেখানে উদীচী নির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসেছে। গতকাল রোববার ছিল সংগঠনটির ৪৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং ৫০তম বছরে পদার্পণ। পঞ্চাশে উদীচী বুড়িয়ে যায়নি, ফুরিয়ে যায়নি। এখনো তাদের দীপ্ত পথচলা।
জৌলুশ বা আড়ম্বরপূর্ণ ছিল না এ আয়োজন। তবে তা ছিল নিখাদ ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। এখানে শামিল হয়েছেন যাঁরা, উদীচীর দর্শনকে চর্চা করছেন যুগের পর যুগ। এসেছিলেন অশীতিপর থেকে তরুণ কিশোরেরাও। এখানে উঠে এসেছে ’৬৮ সালে পুরান ঢাকার নারিন্দায় সাইদুল ইসলামের বাসায় সত্যেন সেন, গোলাম মোহাম্মদ ইদু, আখতার হুসেন, ইয়াহিয়া বখত্, রিজিয়া বেগম, কবিয়াল আব্দুল খালেকসহ কয়েকজন তরুণ মিলে করা সেই সভাটির কথা। সেখানেই উদীচী গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। উঠে এসেছে চামেলীবাগের সেই বাসাটির কথা, যেখানে উদীচীর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। উঠে এসেছে ৪৯ বছরের পথচলার কথা।
গতকাল বিকেলে রাজধানীর কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনের বাইরে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে উৎসবের উদ্বোধন করেন প্রবীণ কৃষকনেতা কাজী সোহরাব হোসেন। ‘চলছি তো অবিরাম মানুষের মিছিলে, লড়ছি তো মুক্তির শপথে’ স্লোগানটির প্রসঙ্গ তিনি তুলে আনেন উদ্বোধনী বক্তৃতায়। বলেন, এর মাঝেই মানুষের মুক্তির কথা রয়েছে।
উদ্বোধন ঘোষণার পর উদীচীর সংগঠন সংগীত ‘আরশির সামনে একা একা দাঁড়িয়ে’ পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা। ঢোল, তবলা, বাঁশিসহ নানা বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজে অনুষ্ঠানস্থল দারুণ সচকিত হয়। নেচে ওঠেন প্রাঙ্গণে উপস্থিত উদীচীর শিল্পী-কর্মীসহ সবাই।
আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর মিষ্টি আর নিমকির স্বাদ নিয়ে সমাগতরা ঢুকে পড়েন কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে। সেখানে দ্বিতীয় পর্বের শুরুতে প্রদর্শিত হয় সদ্যপ্রয়াত, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী জসিমউদ্দিন মণ্ডলের জীবনীর ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ফায়ারম্যান। তথ্যচিত্রে দেখা যায়, সত্যেন সেনের সঙ্গে জেলখানায় এক বছর থাকার স্মৃতির কথা বলছেন জসিমউদ্দিন মণ্ডল।
সফিউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে ছিল আলোচনা। এ পর্বের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন উদীচীর কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার। আলোচক হিসেবে অংশ নেন উদীচীর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ও সাবেক সভাপতি গোলাম মোহাম্মদ ইদু, সাবেক সভাপতি কামাল লোহানী, শিল্পী আনোয়ার হোসেন, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের সভাপতি মাহফুজা খানম, অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ প্রমুখ। তাঁদের সবার বক্তব্য একটা বিষয়ই যেন কোরাস হয়, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নানা পর্বের দুর্যোগে, সংকটে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনসহ দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জনসাধারণের দাবি আদায়ের সংগ্রামে উদীচী যুগে যুগে রাজপথে থেকেছে। মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে উদীচী আগামী দিনেও মানুষের পাশে থাকবে বলে প্রত্যাশা করেন তাঁরা। এ পর্বটি সঞ্চালনা করেন অমিত রঞ্জন দে।

অনুষ্ঠানের তৃতীয় পর্বে ছিল সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। সঙ্গীতা ইমামের সঞ্চালনায় এ পর্বে ছিল উদীচী, বহ্নিশিখা ও ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীদের সমবেত পরিবেশনা। এসব গানে কখনো ছিল দেশমাতৃকার অনুরাগের কথা, কখনো প্রতিরোধ-প্রতিবাদের দীপ্ত উচ্চারণ। ‘হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো’ গানের সঙ্গে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করেন উদীচীর নৃত্যশিল্পীরা। শেষে একক কণ্ঠে গণসংগীত পরিবেশন করেন পশ্চিমবঙ্গের গণসংগীতশিল্পী অসীম গিরি।