মোমেনার লালজমিন

লালজমিন নাটকের দৃশ্যে মোমেনা চৌধুরী
লালজমিন নাটকের দৃশ্যে মোমেনা চৌধুরী

বছর সাতেক আগে শিল্পকলা একাডেমির একটি মহড়াকক্ষে মোমেনা চৌধুরীকে দেখে চমকে উঠেছিলাম। টিভি নাটকে তাঁকে দেখেছি, কিন্তু যোগ্যতা অনুযায়ী চরিত্র পাননি সেখানে। এখানে এ এক অন্য মোমেনা। সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় লালজমিন নাটকের মহড়ায় মোমেনাকে দেখি আর অবাক হই। একেক দৃশ্য আসে আর একেক মোমেনাকে আবিষ্কার করি। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই মহড়াকক্ষে জন্ম হতে চলেছে দুর্দান্ত একটি মঞ্চ নাটকের।

সেই নাটকের প্রথম প্রদর্শনী হয় ২০১১ সালের ১৯ মে। এরপর কেটে গেছে ছয়টি বছর। মোমেনা এখনো অক্লান্তভাবে অভিনয় করে চলেছেন এই একক নাটকে। মঞ্চ নাটক রচনায় সিদ্ধহস্ত মান্নান হীরার লেখা নাটকটি সুদীপের অসাধারণ হাতের ছোঁয়ায় বহু পরিশ্রমে আর সৃজনশীলতার মিশেলে এক অনবদ্য শিল্পে পরিণত করেছেন মোমেনা। শূন্যন রেপার্টরির এই নাটকটি এখন স্কুলে যাচ্ছে, কলেজে যাচ্ছে।

অন্যদিক থেকে একটু দেখার চেষ্টা করি। এখন যারা স্কুল-কলেজে পড়ছে, তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় মুক্তিযুদ্ধ নেই। শুনে, দেখে, পড়ে মুক্তিযুদ্ধের কাছে পৌঁছাতে হয় তাদের। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সময়টায় রাজনীতি আর সংস্কৃতি চলেছিল পরস্পরের হাত ধরে। তারপর কোনো এক সময় সেই বাঁধন ছিন্ন হয়েছে। সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে গেছে রাজনীতি। পড়াশোনার চাপে নাচ-গান-কবিতা-নাটকের সঙ্গে বোঝাপড়াও হচ্ছে না অনেকের। আর তাই শিকড়ের অনুভূতির কাছাকাছি হওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

লালজমিন সেই দূরত্ব ঘুচিয়ে দেওয়ার একটি পথ হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৩-১৪ বছর বয়সী বালিকা তার চোখ দিয়ে দেখেছে সংগ্রাম। মানিক বিলের লাল পদ্মের জন্য ছিল যে মেয়েটির আকুতি। বাবা-মায়ের মধ্যরাতের গুঞ্জন শোনে সে, বাবা চলে যান মুক্তিযুদ্ধে। বালিকাও যেতে চায় যুদ্ধে, কিন্তু বয়স তাকে অনুমোদন দেয় না। পুরুষ যোদ্ধাদের শহীদ হওয়া, পাঁচ যুবতীসহ যুদ্ধযাত্রী কিশোরী মেয়েটির জীবনের নানা অভিজ্ঞতা দর্শকের হৃদয়কে হিম করে দেয়।

নাটকের কাহিনি বলে দিয়ে সামনে থেকে নাটক দেখার আনন্দ নষ্ট করা উচিত নয়। শুধু মোমেনার কাছ থেকে শুনে নেওয়া যাক তাঁর এই নাটকে অভিনয়ের অভিজ্ঞতার কথা।

শূন্যন থেকে তো মঞ্চস্থ হয়েইছে নাটকটি। এরপর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র অনুদান জোগাড় করে দিয়েছে। তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন কলেজে নাটকটি পৌঁছে গেছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ৪৪টি প্রদর্শনীর দায়িত্ব নিয়েছে। শিল্পকলা একাডেমির পাশাপাশি বিভিন্ন কলেজেও হবে লালজমিন।

মোমেনাকে জিজ্ঞেস করি, ‘কেমন লাগে এই নাটকে অভিনয় করে?’
মোমেনার কাছে এ এক অপার্থিব অনুভূতি। স্কুল-কলেজে মঞ্চায়নের আগে তিনি বুঝতে পারেননি, মুক্তিযুদ্ধের নাটক দিয়ে এভাবে ধরা যায় নতুন প্রজন্মকে। ‘একেকটা মঞ্চায়ন শেষ হলে একেক অনুভূতি হয়। কেউ জড়িয়ে ধরে কাঁদে। এক ঘণ্টার মধ্যে ওরা মুক্তিযুদ্ধ দেখতে পায়, অনুভব করতে পারে, দেশকে ভালোবাসতে শেখে, বুঝতে পারে দেশ স্বাধীন করতে কত কষ্ট করেছে আমাদের মা-বোনেরা। মাত্র ১ ঘণ্টা ১০ মিনিটে মুক্তিযুদ্ধ পরিভ্রমণ করে আসে ওরা। অনেকে নাটক শেষে কথা বলতে পারে না। আমি বুঝতে পারি, আমার আরও কাজ বেড়ে যাচ্ছে। স্বস্তি হয়, মুক্তিযুদ্ধের ভাবনাটা তো তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দিতে পারছি।’
লালজমিন তার ১২৫তম মঞ্চায়ন শেষ করেছে, এগোচ্ছে ১৫০-এর দিকে। তারপর আরও সামনে এগিয়ে চলবে সে।