বেহালা ও বাঁশির সুরে নবান্ন উৎসব শুরু

নাচ-গানের মধ্য দিয়ে উদ্‌যাপিত হয় নবান্ন উৎসব। ছবি: প্রথম আলো
নাচ-গানের মধ্য দিয়ে উদ্‌যাপিত হয় নবান্ন উৎসব। ছবি: প্রথম আলো

ভোর থেকেই মেঘলা আকাশ। সকাল সাতটায় পাখপাখালির ঘুম ভেঙেছিল বটে, তবে শিশিরভেজা গাছপালার পাতায় রোদের ছোঁয়া লাগেনি তখনো। চারুকলার বকুলতলায় এমন সময় বেজে উঠেছিল বাঁশির সুর। আর এক-দুই করে করে সেই গাছতলায় এসে উপস্থিত হতে শুরু করলেন শিল্পী ও শ্রোতারা।

আজ বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলায় নবান্ন উৎসবের শুরুটা এভাবেই হয়েছিল। আজ পয়লা অগ্রহায়ণ প্রতিবছরের মতো অনুষ্ঠিত হলো জাতীয় নবান্ন উৎসব। জাতীয় নবান্নোত্সব উদ্‌যাপন পর্ষদ আয়োজিত দিনব্যাপী উৎসবটি হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় এবং ধানমন্ডি রবীন্দ্রসরোবর মুক্তমঞ্চে।

সকাল ৭টা ১ মিনিটে প্রথমে মোহাম্মদ নুরুজ্জামানের বেহালা এবং পরে গাজী আবদুল হাকিমের বাঁশির সুরে উৎসবের শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান উৎসবের উদ্বোধন করেন। ‘নবান্ন কথন’ পর্বে তাঁর সঙ্গে অংশ নেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, জাতীয় নবান্নোৎসব উদ্‌যাপন পর্ষদের সভাপতি লায়লা হাসান, পর্ষদের আহ্বায়ক শাহরিয়ার সালাম, উৎসবের পৃষ্ঠপোষক ল্যাব এইড ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এ এম শামীম।

নবান্ন উৎসবে এসে শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করে উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘এই নবান্ন উৎসব একটি উদার, সর্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক উৎসব। গ্রামীণ সম্প্রদায়ের মানুষের এই উৎসব গণমানুষের উৎসব, খেটে খাওয়া মানুষের উৎসব।’ গণমুখী, মানবতাবাদী মানুষ হতে গেলে, একটি উদার-নৈতিক সমাজ গড়তে গেলে গণমানুষের উৎসব নবান্নে শামিল হতেই হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

গোলাম কুদ্দুছ আক্ষেপ করেন, ‘হাজার বছরের চিরায়ত এই উৎসব নগরায়ণের প্রভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। নাগরিক তরুণেরা আমাদের এই সর্বজনীন উৎসবের সঙ্গে পরিচিত নয়। গ্রামীণ পিঠাপুলি তো তারা অনেকেই চেনে না। তরুণদের শিকড়ে ফেরাতে হলে আমাদের এই গ্রামীণ উপাদানগুলো নগরে আরও বেশি করে তুলে ধরতে হবে।’

চারুকলা অনুষদ থেকে বিভিন্ন লোকজ অনুষঙ্গ নিয়ে এক শোভাযাত্রা বের করে নবান্নোৎসব উদ্‌যাপন পর্ষদ। শোভাযাত্রাটি টিএসসি মোড় ঘুরে আবার চারুকলায় এসে শেষ হয়। ছবি: প্রথম আলো
চারুকলা অনুষদ থেকে বিভিন্ন লোকজ অনুষঙ্গ নিয়ে এক শোভাযাত্রা বের করে নবান্নোৎসব উদ্‌যাপন পর্ষদ। শোভাযাত্রাটি টিএসসি মোড় ঘুরে আবার চারুকলায় এসে শেষ হয়। ছবি: প্রথম আলো

লায়লা হাসান এ উৎসবে লোকজ সংস্কৃতি উপস্থাপনের পাশাপাশি এই অস্থির সময়ে বাঙালিকে সম্প্রীতির বন্ধনে বাধার আশা করেন। পয়লা অগ্রহায়ণের নবান্ন উৎসবকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পাশাপাশি এই দিনে সরকারি ছুটির আবেদন জানান উৎসব পর্ষদের আহ্বায়ক শাহরিয়ার সালাম।

উৎসবের সাংস্কৃতিক পর্বের শুরুতে ছিল সমবেত নৃত্য পরিবেশনা। ‘আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে’ গানের সঙ্গে সম্মেলক নৃত্য পরিবেশন করে নটরাজ ও নৃত্যজন। ‘চল যাইতে ধান কাইটা আনিতে’ ও ‘দিন যায় দিন আসে’ গান দুটির সঙ্গে নৃত্যম সম্মেলক নৃত্য পরিবেশন করে। ‘চাষি ভাই আয় রে’ গানের সঙ্গে নৃত্যজন, লোকজ গানের কম্পোজিশনের সঙ্গে কাঁদা মাটি ও স্পন্দন সম্মেলক নৃত্য পরিবেশন করে। সম্মেলক গান পর্বে ‘কাটি ধান কাটি ধান আয় রে’ গান পরিবেশন করে বহ্নিশিখা, ‘মাঠে মাঠে সোনালি ধান’ পরিবেশন করে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী পরিবেশন করে ‘আমার জমবে মেলা বটতলা হাট’ গানটি।

একক গান পর্বে ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি’ লালনগীতি শোনান ফরিদা পারভীন, শাহীন সামাদ শোনান কাজী নজরুল ইসলামের ‘এ কী অপরূপ রূপে মা তোমায়’, সুমা রায় শোনান ‘আমি তোমারই মাটির কন্যা’, শামা রহমান শোনান ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়। আবৃত্তি পর্বে নায়লা তারান্নুম আবৃত্তি করেন কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাংলাদেশ’ কবিতাটি, শিমুল মুস্তাফা আবৃত্তি করেন সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার পরিচয়’ কবিতাটি। শেষে গারো সম্প্রদায়ে নবান্ন উৎসব ‘ওয়ানগালা’র ঐতিহ্য পরিবেশন করেন নৃত্য সংগঠন আচিকের শিল্পীরা।

পরে চারুকলা অনুষদ থেকে বিভিন্ন লোকজ অনুষঙ্গ নিয়ে এক শোভাযাত্রা বের করে নবান্নোৎসব উদ্‌যাপন পর্ষদ। শোভাযাত্রাটি টিএসসি মোড় ঘুরে আবার চারুকলায় এসে শেষ হয়। শোভাযাত্রা শেষে চারুকলার বকুলতলায় চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণের শুরু হয় নবান্নের আর্ট ক্যাম্প। এতে অংশ নেন দেশের নবীন প্রবীণ শিল্পীরা। জলরং আর অ্যাক্রিলিকের ক্যানভাসে উঠে আসে গ্রামবাংলার লোকজ ঐতিহ্যের গল্প।

বিকেলে চারুকলার বকুলতলার মঞ্চে ঢাক-ঢোলের মাধ্যমে শুরু হয় উৎসবের দ্বিতীয় পর্ব। আয়োজকেরা জানান, বিকেলের পর্বে থাকছে চারুকলার বকুলতলায় মানিকগঞ্জের চান মিয়া ও তাঁর দলের লাঠিখেলা, নড়াইলের পটগান, নেত্রকোনার দিলু বয়াতি ও তাঁর দলের ‘মহুয়ার পালা’ ছাড়াও নবীন-প্রবীণ কণ্ঠশিল্পীদের একক গান। বিকেল চারটায় উৎসবের অন্য পর্বে রবীন্দ্রসরোবর মুক্তমঞ্চে থাকবে নবান্ন উৎসবের আয়োজন।