চার দশকে বড় পাওয়া মঞ্চনাটক

মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে গতকাল সন্ধ্যায় গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের নিবন্ধিত দল ঢাকা নান্দনিক পরিবেশিত নাটকের দৃশ্য l ছবি: সাইফুল ইসলাম
মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে গতকাল সন্ধ্যায় গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের নিবন্ধিত দল ঢাকা নান্দনিক পরিবেশিত নাটকের দৃশ্য l ছবি: সাইফুল ইসলাম

ব্যস্ত এই রাস্তাটির পোশাকি নাম ‘নাটক সরণি’। তবে এটা বেইলি রোড নামেই বেশি পরিচিত। শহরের অন্য রাস্তার তুলনায় এই রাস্তাটিকে আলাদাভাবে চেনা যায় ভিন্ন দুটি ভবনের কারণে। দুপাশের খাবার আর পোশাকের দোকান ছাপিয়ে আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মহিলা সমিতি এবং গাইড হাউস। এই দুই মিলনায়তনের দুটি মঞ্চকে কেন্দ্র করেই মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে লেখা হয়েছে মঞ্চনাটকের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। দুটি মিলনায়তনের মধ্যে বর্তমানে একটি চালু আছে। গাইড হাউসে এখন নাটক হয় না। তবে রাজধানীর জাতীয় নাট্যশালাসহ বেশ কিছু মঞ্চে নাটকের প্রদর্শনী হচ্ছে নিয়মিত।

সত্তরের দশকে একদল স্বাপ্নিক ও মেধাবী যুবকের হাত ধরে এ দেশে শুরু হয় মঞ্চনাটকের পথচলা। মঞ্চনাটককে অনেকেই চিহ্নিত করেন মুক্তিযুদ্ধের একটি ফসল হিসেবে। যুদ্ধোত্তর দেশে মঞ্চনাটক যাঁদের হাতে গড়ে ওঠে, সমৃদ্ধি পায়, শক্তিশালী ‘গ্রুপ থিয়েটার’ আন্দোলনে দাঁড়ায়—তাঁরা নিজেরা নানা মাত্রায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। কালের পরিক্রমায় সেই মঞ্চনাটক দেশের শিল্পমাধ্যমে নিজের একটি আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। এই গৌরবোজ্জ্বল যাত্রাপথে আলো ছড়িয়েছেন আবদুল্লাহ আল মামুন, সাঈদ আহমদ, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিম আল দীন, এস এম সোলাইমান, হুমায়ুন ফরিদী, খালেদ খান, মমতাজউদ্দীন আহমেদ, আলী যাকের, আবুল হায়াত, মামুনুর রশীদ, ফেরদৌসী মজুমদার, সারা যাকের, তারিক আনাম খান, জামিল আহমেদ, সুবর্ণা মোস্তফা, আফজাল হোসেন, লাকী ইনাম, শিমূল ইউসুফ, রোকেয়া রফিক বেবী প্রমুখের মতো নাট্যজনেরা। মঞ্চকর্মীরা আলোকিত করে রেখেছেন বাংলাদেশের নাটক, চলচ্চিত্র আর সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন মাধ্যমকে।

১৯৮০ সালের ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। প্রথমবার সভাপতিমণ্ডলীর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন রামেন্দু মজুমদার এবং সেক্রেটারি জেনারেল নাসির উদ্দীন ইউসুফ। বর্তমানে এ সংগঠনে সারা দেশের ৩৫০টি দল যুক্ত আছে। এ বছর ৩৭ বছরে পদার্পণ করছে সংগঠনটি। দিনটি উদ্‌যাপন করতে আজ বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার হলে ‘বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় নারীর সৃজনশীলতার প্রকাশ’ বিষয়ে সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে।

 গত চার দশকে নাট্য সংগঠনগুলোও নিজস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছে। নতুন নতুন নাট্যদল গড়ে উঠছে তাদেরই সচেতন প্রয়াসে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সঙ্গেও যোগাযোগ বেড়েছে। এই তো দুই বছর আগে শেক্‌সপিয়ারের বিশ্বখ্যাত গ্লোব থিয়েটার জাতীয় নাট্যশালায় মঞ্চস্থ করে হ্যামলেট নাটকটি। দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাট্যতত্ত্বের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে নাট্যচর্চা করে যাচ্ছেন নাট্যকর্মীরা। নাটক ও নাট্যতত্ত্ব শিক্ষার বিষয় হয়ে উঠেছে দেশের বেশ কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটআই) কেন্দ্রীয় সভাপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেন রামেন্দু মজুমদার।

রামেন্দু মজুমদার প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে, যেখানে কোনো অবকাঠামো নেই, এমন একটি জায়গা থেকে আমাদের
থিয়েটার শুরু। এখানে নাটক শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, ঠিকঠাক একটি মঞ্চ এমনকি পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ছিল না। এর মধ্যে থেকে যাঁরা শুরু করেছিলেন, তাঁরা প্রকৃতপক্ষেই শিল্পী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ।’

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন করে আরণ্যক নাট্যদল। ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে নাটকটির প্রথম মঞ্চায়নে আলী যাকের, সুভাষ দত্ত, ইনামুল হক ও মামুনুর রশীদের মতো প্রথিতযশা শিল্পীরা অংশ নিয়েছিলেন। পরের বছর ১৯৭৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের বাকি ইতিহাস মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নাটকে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়। এটিই ছিল দর্শনীর বিনিময়ে প্রদর্শিত প্রথম নাটক। প্রথম আলোকে নাট্যকার মামুনুর রশীদ বলেন, ‘নাটক যে একটি নিয়মিত চর্চার শিল্পমাধ্যম হতে পারে, এ বোধ তাঁদের জন্মেছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় বিভিন্ন নাট্যদলের কাজ দেখে। স্বাধীনতার পরের সময়টাতে বুকের মধ্যে চাপা আকাঙ্ক্ষা ছিল নাটক করব।’

এই কয় বছরে, শুধু দেশীয় গল্প বা স্থানীয়দের লেখায় সীমাবদ্ধ ছিল না দেশের থিয়েটার চর্চা। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের মঞ্চে শেক্‌সপিয়ার, স্যামুয়েল বেকেট, ব্রের্টল্ট ব্রেখট, জাঁ পল সার্ত্রে, আলবেয়ার কামু, মলিয়ের, হেনরিক ইবসেনদের উপস্থিতি ঋদ্ধ করে চলেছে স্থানীয় থিয়েটার চর্চাকে। নাট্যচর্চা ছড়িয়ে পড়েছে শহরের সীমানা ছাড়িয়ে। তবে মামুনুর রশীদের মতে, অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী ছাড়া অন্য জায়গায় থিয়েটার চর্চাটা কেন্দ্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের বর্তমান মহাসচিব আখতারুজ্জামান বলেন, থিয়েটার খুবই ব্যয়বহুল একটি মাধ্যম। একটি নাটক তৈরি করতে গড়ে প্রায় ৩০ জন মানুষের তিন-চার মাসের শ্রম, মেধা এবং আনুষঙ্গিক সবকিছু মিলিয়ে বিরাট আয়োজনের ব্যাপার। তাই বাংলাদেশে থিয়েটার বিষয়টা অর্থনৈতিক জায়গা থেকে সম্পূর্ণভাবে একটি অলাভজনক খাত। ঢাকায় তা-ও সব দলেরই কিছু টিকিট বিক্রি করে সামান্য অর্থ পাওয়া যায়। কিন্তু ঢাকার বাইরে টিকিট বিক্রি করে থিয়েটার চালানো কষ্টকর।

গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের নেতারা মনে করেন, মঞ্চনাটকের ক্রমাগত পরিবর্তন হয়েছে মূলত নাট্যকর্মীদের আন্তরিকতার কারণে। তবে শুধু গ্রুপ থিয়েটার বা মঞ্চনাটকের কর্মীরা এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে যথেষ্ট নন। দেশের অন্যতম প্রধান এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তা, ধনী ব্যক্তি ও ফাউন্ডেশনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।