'এখন থেকে নিয়মিত নাটক দেখব!'

>২০০৬ সালে লোক নাট্যদল তাদের জনপ্রিয় প্রযোজনা কঞ্জুস-এর ৫০০তম মঞ্চায়ন করে সাড়া ফেলেছিল। গেল শুক্রবার জাতীয় নাট্যশালার মূল মঞ্চে নাটকটির ৭০০তম প্রদর্শনী করে আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। সেদিন নাটকটি দেখে লিখেছেন মাসুম আলী
কঞ্জুস নাটকের দৃশ্য
কঞ্জুস নাটকের দৃশ্য

জাতীয় নাট্যশালার সিডির পাশেই রিকশার গ্যারেজ! এখানে গ্যারেজ কেন? মনে মনে প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে বিস্ময় বাড়ল ওপরে উঠে। করিডরে চায়ের দোকান। গ্রামোফোনে সাদাকালো সময়ের হিন্দি গান বাজছে। অন্যদিকে বাখরখানির দোকান সাজিয়েছেন আরেকজন। দৃশ্যটা অভিনব। তবে যাঁরা পুরান ঢাকায় বড় হয়েছেন, তাঁদের কাছে খুব পরিচিত। স্মৃতির জানালায় টোকা দেবে। এ যেন কায়েতটুলি, মালিটোলা কিংবা নারিন্দার কোনো একটা গলি।

গেল শুক্রবার জাতীয় নাট্যশালা বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছিল কঞ্জুস নাটকের ৭০০তম প্রদর্শনীকে উপলক্ষ করে। নাটকের নাম কঞ্জুস হলেও এই রজনীটি উদ্যাপনে সেদিন যথেষ্ট উদার ছিলেন লিয়াকত আলী লাকীর নেতৃত্বে থাকা লোক নাট্যদলের (সিদ্ধেশ্বরী) কর্মীরা। প্রদর্শনীর আগেই নানা আয়োজনে মুখরিত হয়েছিল এদিন। নাটক শুরুর আগে নাটকের পোশাক, প্রপস নিয়েই রীতিমতো উৎসবে মেতেছিলেন তাঁরা।

সুবিশাল মিলনায়তনের প্রতিটি আসন পূর্ণ ছিল এই রাতে। সবার অপেক্ষা ছিল নাটকের জন্য। তবু শুরুর আগে আলোচনা আর সম্মাননা পদক দেওয়া-নেওয়ার সময়টা ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়নি। বিশেষ করে অতীতে কঞ্জুস নাটকে নির্দেশক লিয়াকত আলীর অভিনয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে সংস্কৃতিমন্ত্রীর সরস বক্তব্য দর্শকদের বাড়তি আনন্দ দেয়।

অধুনা দেশে-বিদেশে চর্চিত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ম্যাচের মতোই মনে হলো কঞ্জুস নাটকটিকে। দুই ঘণ্টার নাটকে পুরোটাই বিনোদন। প্রথম দৃশ্যেই হাসির রসদ পেয়ে যান দর্শক। যৌক্তিক-অযৌক্তিক নানাভাবে হাসির রসদ মেলে নাটকে। সংলাপে, শরীরের ভাষায় কারণে-অকারণে শিল্পীরা বিনোদন দিতে থাকেন। হাসি, করতালি তো ছিলই, মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক শিসও শোনা গেল।

মিলনায়তনের বাঁ সারির এক পাশে হুইলচেয়ারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বসে ছিলেন একজন। মাঝে মাঝে অট্টহাসিতে নিজের অনুভূতি জানান দিচ্ছিলেন তিনি। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। নজরুল ইসলাম খাদ্য মন্ত্রণালয়ে সহকারী উপপরিদর্শক হিসেবে কাজ করছেন। জন্ম থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধী, হুইলচেয়ারে চলাফেরা। জানালেন, কঞ্জুস নাটকের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করেছেন। পাশেই দর্শক সারির তৃতীয় আসনে বসে ছিলেন ইস্কাটন থেকে আসা তরুণ চিকিৎসক সাবরিনা হোসেন। জীবনে প্রথমবার কোনো মঞ্চনাটক দেখতে এসেছেন। বললেন, ‘আজ হুট করেই শীত নেমেছে। নাটক শুরুর আগে আলোচনার সময় খুব শীত লাগছিল হলে। কিন্তু নাটক শুরুর কিছুক্ষণ পর ভুলেই গেলাম শীত। মঞ্চনাটক এত মজার হয় ধারণাই ছিল না। এখন থেকে নিয়মিত নাটক দেখব!’

নাটক শেষে বের হওয়ার সময় তরুণ এই চিকিৎসকের মন্তব্য শুনে শুরুতে আলোচনা পর্বে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছের কথা মনে পড়ে গেল। শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, কঞ্জুস বাংলাদেশে মঞ্চনাটকের দর্শক সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

নতুন দর্শকের পাশাপাশি পুরোনো অনেক দর্শক এদিন কঞ্জুস দেখতে এসেছিলেন। বিদ্যুৎ নামের একজন দর্শক ২০০ বারেরও বেশি নাটকটি দেখেছেন। তিনি বলেন, ‘গল্প এক। তবে প্রতিবারই মনে হয় নতুন কিছু হচ্ছে এই নাটকে।’ নির্দেশক লিয়াকত আলী বলেন, ‘আমি মনে করি, যে নাটকগুলো নিয়মিত মঞ্চস্থ হয়, সেগুলোতে অন্তত পাঁচ বছর পর পর কিছুটা পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। কারণ এই সময়ের মাঝে দর্শকের মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন আসে। নতুন নতুন দর্শক আকর্ষণের একটা ব্যাপার থাকে।’

দর্শক আকর্ষণে পুরোপুরি সফল তা সহজেই বলা যায়। সেই পরিবর্তনটা নানা সময়ে দেখা যায়। ১৯৮৬ সালের ৮ মে প্রথম মঞ্চে আসা নাটকের সংলাপে এসেছে সেলফি, আইফোন, ব্লু হোয়েল গেম এমনকি ঢাকা অ্যাটাক-এর কথাও!

যা বললেন ‘কঞ্জুস’
নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘কঞ্জুস’ হায়দার আলী খানের চরিত্রে অভিনয় করেছেন স্বদেশ রঞ্জন দাশগুপ্ত। নাটকে সবাই ভালো অভিনয় করেছেন, তবে হায়দার আলীর চরিত্রটি নিয়ে নাটক শেষে আলোচনা শোনা যায় বেশি। নাটকের প্রায় প্রতিটি দৃশ্যে তার সরব উপস্থিতি। পুরান ঢাকার বাসিন্দা বা সেখানকার ভাষা নিয়ে যাঁদের ধারণা আছে, তাঁরা এক বাক্যে স্বীকার করবেন, নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রের সংলাপে নির্ভুল ‘ঢাকাইয়া’ উচ্চারণটা পাওয়া যায়। বাচিক, আঙ্গিক—দুই অভিনয়ে ভালো নম্বর নিয়ে উত্তীর্ণ হবেন তিনি।

নাটক শেষে কথা হলো স্বদেশ রঞ্জন দাশগুপ্তর সঙ্গে। বললেন, ১৯৯৬ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে তিনি ‘কঞ্জুস’-এর দায়িত্ব পালন করছেন। তিন শতাধিক প্রদর্শনীতে তিনি এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ২০০৪ সাল থেকে মঞ্চনাটকের সঙ্গে যুক্ত। আগে পুরোদস্তুর বডিবিল্ডার ছিলেন। জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার জিতেছেন।

এত সুন্দর করে কীভাবে চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি পুরান ঢাকার ওয়ারী এলাকায় থাকি। এখানেই বড় হয়েছি। নবাবপুর স্কুল, কবি নজরুল কলেজ, জগন্নাথ কলেজে লেখাপড়া করেছি। যখন এই চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব পাই, তখন থেকেই কান্দুপট্টি, আলুবাজার, সিদ্দিকবাজার, বংশাল, কায়েতটুলিতে রুটিন করে ঘুরে বেড়াতাম। সেখানকার বাসিন্দাদের রসবোধ থেকে শুরু করে পোশাক, আচার-আচরণসহ নানা কিছু পর্যবেক্ষণ করতাম। তাই হয়তো হায়দার আলীর চরিত্রটা উৎরে গেছে।’

পুনশ্চ: ২০০৫ সালে লোক নাট্যদলের কঞ্জুস নাটকটি যখন চলছিল, তখন দলটি বিভক্ত হয়। দলের বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সদস্য লোক নাট্যদল (বনানী) হিসেবে কার্যক্রম শুরু করেন। কামরুন নূর চৌধুরীর নির্দেশনায় তাঁরাও নাটকটি নিয়মিতভাবে মঞ্চস্থ করেন।