প্রাণজুড়ালেন যাঁরা

>

সব অনিশ্চয়তাকে মিথ্যা প্রমাণ করে ষষ্ঠবারের মতো হয়ে গেল বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব। পাঁচ রাতব্যাপী এবারের উৎসবের যে পরিবেশনাগুলো মন কেড়ে নিয়েছিল, তারই কয়েকটির কথা জানাচ্ছেন প্রণব ভৌমিক রাসেল মাহ্‌মুদ

পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া
পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া

অর্কেস্ট্রায় মিলল পূর্ব-পশ্চিম

উৎসবের মঞ্চে এই প্রথম প্রাচ্যের ধ্রুপদি সংগীতের সঙ্গে ছিল প্রতীচ্যের ধ্রুপদি সংগীতও। কাজাখস্তানের আস্তানা সিম্ফনি ফিলহারমোনিক অর্কেস্ট্রা বাজিয়েছে দক্ষিণ ভারতের বেহালাসম্রাট ড. এল সুব্রামানিয়ামের সঙ্গে।

প্রথমে রাগ আভোগী দিয়ে শুরু হয় সুব্রামানিয়ামের পরিবেশনা। পরে আস্তানা অর্কেস্ট্রা বাজায় পি আই চাইকোভস্কির অমর সৃষ্টি ‘সোয়ান লেক’-এর কিছু অংশ। এরপর সুব্রামানিয়ামের সৃষ্ট রাগ শান্তিপ্রিয়ায় মিলে যায় পূর্ব-পশ্চিমের ধ্রুপদি সংগীত।

এবারের উৎসব শুরুই হয় এই অনির্বচনীয় পরিবেশনা দিয়ে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা মুগ্ধ হয়ে শ্রোতারা তা শোনেন। আগের দিন প্রথম আলোকে সুব্রামানিয়াম বলেছিলেন, সাত সুর থেকেই তো সব সংগীত। সেই সাত সুর পুবে যা, পশ্চিমেও তা-ই। সুতরাং এই মিলনে অপূর্ব কিছুই তৈরি হবে। বলা বাহুল্য, সেটাই ফলে যায় অক্ষরে অক্ষরে।

কলা রামনাথ
কলা রামনাথ

কলা রামনাথ জাত চেনালেন

বেহালার আরেক কিংবদন্তি ড. এন রাজমের ভাতিজি কলা রামনাথ। হাতেখড়ি নিয়েছিলেন এন রাজমের কাছেই। একদিন ওস্তাদ জাকির হোসেন তাঁর বাজনা শুনে বলেছিলেন, ‘তুমি ভালো বাজাও। কিন্তু আমি কেন একজন এন রাজমের কপি শুনব, যেখানে চাইলেই আসল এন রাজমকে শুনতে পাওয়া যায়!’

এ কথা শুনেই নিজের গুরু পরিবর্তন করলেন কলা রামনাথ। শিষ্যত্ব নিলেন পণ্ডিত যশরাজের।

উৎসবের চতুর্থ আসরে এন রাজম এসেছিলেন তাঁর বেহালা শোনাতে। আর এবার এলেন কলা রামনাথ। দুই শিল্পীর বেহালাবাদনে এখন স্পষ্ট ফারাক দেখা যায়। রাগ নট ভৈরব ও বসন্তে নিজের জাত চেনালেন কলা রামনাথ।

পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী
পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী

কুয়াশা তাড়ালেন অজয় চক্রবর্তী

গান গেয়ে তানসেন নাকি বৃষ্টি নামিয়েছিলেন, আর পণ্ডিত যশরাজ তুলেছিলেন ধুলোঝড়। সম্প্রতি তেমনই এক ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন ঢাকার সংগীতপ্রেমীরা। একপাল কুয়াশাকে ডেকে এনে আবার তাড়িয়ে দিয়েছেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী।

ঘটনা উৎসবের তৃতীয় রাতের। সেই রাতের শেষ পরিবেশনা ছিল অজয় চক্রবর্তীর। শেষ রাতে বহু মানুষ তাঁর গান শোনার জন্য মাঠে উপস্থিত। শ্রোতাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে গাইতে শুরু করেন তিনি। ধরেন ভক্তি ও করুণার রাগ গুনকেলি। কিছুক্ষণের মধ্যে মাঠের দর্শকসারি, মঞ্চ ঢেকে যায় গাঢ় কুয়াশায়। এমন দৃশ্যের অবতারণায় দারুণ উচ্ছ্বসিত হন অজয় চক্রবর্তী। গানের ফাঁকে শ্রোতাদের সঙ্গে সেই উচ্ছ্বাস ভাগাভাগি করে নেন তিনি। তাঁর সেই রাগ গাওয়া শেষ হলে কুয়াশাও হারিয়ে যায়।

কেউ কেউ দারুণ আন্দোলিত হন এই ঘটনায়। এ নিয়ে পরে বেশ আলোচনাও হয়। গল্পচ্ছলে একজন তো বলেই ফেলেছিলেন, ‘অজয় চক্রবর্তী “যা” বলতেই নাকি কুয়াশা চলে গেছে।’

পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার ও ড. মাইসোর মঞ্জুনাথ
পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার ও ড. মাইসোর মঞ্জুনাথ

অনবদ্য যুগলবন্দী

যুগলবন্দী কথাটা শুনলেই মনে পড়ে যায় রবিশঙ্কর-আকবর আলী খানের সেতার-সরোদ কিংবা বিলায়েত খান-বিসমিল্লাহ খানের সেতার-সানাইয়ের কথা। ‘শিবহরি’ বলে পরিচিত পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা ও পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার সন্তুর-বাঁশির যুগলবন্দীর কথাও আসে মনে। এসব যুগলবন্দী পরিবেশনায় দুটি সুরযন্ত্র যেন এক হয়েই বাজে।

কিন্তু এমন পরিবেশনা সব সময় সরল হয় না। ভালো যুগলবন্দী খুব কালেভদ্রেই দেখা যায়। এখানে দুই শিল্পীর বোঝাপড়াটা খুব দরকার। সেটা ছিল পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার ও ড. মাইসোর মঞ্জুনাথের পরিবেশনায়। সরোদ-বেহালার যুগলবন্দী দিয়ে তাঁরা সবাইকে নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য কোথাও। তবলায় পণ্ডিত যোগেশ শামসি ও মৃদঙ্গমে অর্জুন কুমার দিয়েছিলেন পূর্ণ সহযোগ।

উত্তর ভারতের তেজেন্দ্র ও যোগেশ দক্ষিণ ভারতের মঞ্জুনাথ ও অর্জুনের সঙ্গে মিলে কী অপূর্ব বাজনাই না বাজালেন। যুগলবন্দীতে তাঁরা পরিবেশন করেন রাগ সিমহেন্দ্রমধ্যমম। দক্ষিণ ভারতের এই রাগ পরে উত্তর ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীতে স্থান করে নেয়। সব দিক থেকেই এটি ছিল অনবদ্য এক যুগলবন্দী।

উৎসবে পণ্ডিত রনু মজুমদার ও পণ্ডিত দেবজ্যোতি বসুর বাঁশি-সরোদ এবং রাকেশ চৌরাসিয়া ও পূর্বায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের বাঁশি-সেতারের যুগলবন্দীও শ্রোতাদের হাততালি কুড়িয়েছে।

পরিবারের কাছে আসেন চৌরাসিয়া

৭৯ বছর বয়সে ঘর থেকে বাইরে বের হওয়া, ভ্রমণ করা খুব বেশি স্বস্তিদায়ক নয়। তবু পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া এসেছেন ঢাকায়। ঢাকায় আসবেন বলে সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন। কারণ, এই শহরে তাঁর একটি পরিবার আছে। প্রতিবছর ভোররাতের শেষ একটা প্রহর তিনি কাটান এই পরিবারের সঙ্গে। প্রায় ৪০ হাজার নর-নারী সেই পরিবারের অংশ।

সবার শেষে মঞ্চে উঠে তাদের উদ্দেশে প্রথমেই চৌরাসিয়া বলেন, ‘পৃথিবীর কোথাও আমার এত বড় পরিবার নেই। শরীর পারে না, তবু চলে আসি আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে বলে।’

ঢাকার উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে এ এক বিস্ময়। প্রতিবছর উৎসবের শেষ রাতে লোকজন ঘরে থাকতে পারেন না। প্রতিবার যান বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে। গেল ডিসেম্বরে তাঁরাই চলে এসেছিলেন ধানমন্ডির আবাহনী মাঠে। এবার বাঁশিতে বাজিয়ে শুনিয়েছেন রাগ ললিতা।

চৌরাসিয়া কথা দিয়েছেন, শরীর বাদ না সাধলে এ বছর আবার আসবেন তিনি।

বাংলাদেশের সুপ্রিয়া দাশ
বাংলাদেশের সুপ্রিয়া দাশ

মঞ্চ মাতিয়েছেন বাংলাদেশের শিল্পীরাও

এবারের আসরে বাংলাদেশের শিল্পীরাও চমৎকার সব পরিবেশনা দিয়েছেন। প্রথম রাতে সুপ্রিয়া দাশের খেয়াল মুগ্ধ করেছে শ্রোতাদের। দ্বিতীয় রাতে অভিজিৎ কুণ্ডুর ধ্রুপদও সবার ভালো লেগেছে। তাঁরা দুজনই বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিল্পী। এই প্রতিষ্ঠানের শিল্পীরা বৃন্দ সেতার, সরোদ ও তবলাবাদনে অংশ নিয়েছেন।

চতুর্থ রাতে প্রথমে মঞ্চ মাতান বাংলাদেশের ছয় তরুণ নৃত্যশিল্পী। সুইটি দাস ও সুদেষ্ণা স্বয়মপ্রভা তাথৈ পরিবেশন করেন মণিপুরি নাচ। ভরতনাট্যম পরিবেশন করেন অমিত চৌধুরী ও জুয়াইরিয়াহ মৌলি। মেহরাজ হক তুষার ও স্নাতা শাহরিন নেচেছেন কত্থক। ‘নৃত্য চিরন্তন’ নামের তাঁদের সম্মিলিত এই পরিবেশনা দেখে নিঃসন্দেহে বলা যায়, আমাদের নাচের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।

আরও পরিবেশনা

আরও কয়েকটি পরিবেশনায় শ্রোতারা মুগ্ধ হয়েছেন। এর মধ্যে আছে পণ্ডিত বুধাদিত্য মুখোপাধ্যায়ের সেতার, ওস্তাদ রশিদ খান ও পণ্ডিত যশরাজের খেয়াল, পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার সন্তুর, পণ্ডিত বিশ্বমোহন ভাটের মোহনবীণা, বিদ্বান বিক্কু বিনায়করামের ঘটম, িবদুষী সুজাতা মহাপাত্রের ওডিশি নাচ, অদিতি মঙ্গলদাসের কত্থক এবং সাসকিয়া রাও দু-হাসের চেলো।