ধাক্কা দিয়ে গেল ম্যাওসংকেত্তন

ম্যাওসংকেত্তন গায়ে-গতরে নয়, চিন্তায় ও গভীরতায় আরও তীক্ষ্ণ হয়েছে
ম্যাওসংকেত্তন গায়ে-গতরে নয়, চিন্তায় ও গভীরতায় আরও তীক্ষ্ণ হয়েছে

‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে’—প্রাচীন গ্রিসের ঈশপের নীতি-উপদেশমূলক এই গল্প থেকে নেওয়া এই বাক্যটি এখন সারা বিশ্বের মানুষের মুখে মুখে প্রবাদবাক্য হয়ে ফেরে। চিরশত্রু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে পারলেই ইঁদুরেরা বিড়ালের আগমনধ্বনি শুনতে পেত। আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারত। আজকের বিশ্বে মানুষ তার প্রকৃত শত্রুকে চিনতে ভুল করছে। এর সমাধান খুঁজতে গিয়ে যেসব উদ্ভট কাণ্ড ঘটানো হচ্ছে, তাতে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক-সমাজ-রাষ্ট্রের চিন্তার অসারতা ও প্রকৃত শিক্ষার গোড়ায় গলদ রাখার নানামুখী আয়োজন এখন একধরনের হাসির খোরাকে পরিণত হয়েছে। যা সারা বিশ্বের মানুষকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ইঁদুর-বিড়ালের উপমাকে ব্যবহার করে এই চরম বাস্তবতায় রচিত হয়েছে নাট্যকার মলয় ভৌমিকের এবারের নাটক ম্যাওসংকেত্তন

গত ২৭ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে ছিল নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন। দর্শক সারিতে ছিলেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বললেন, ‘চমত্কার! সরাসরি গল্প বলার ভঙ্গির পরিবর্তে ‘‘নন-রিয়ালিস্টিক ও প্রতীকী ফর্ম’’ ব্যবহার করায় বক্তব্য অনেক বেশি ধারালো ও শিল্পসম্মত হয়েছে। নাটকে সমাজের গতানুগতিক বোধের প্রতি তীব্র শ্লেষ ও বিদ্রূপের ক্রমাগত ধাক্কা মেরে গেছেন নাট্যকার-নির্দেশক।’ তিনি আরও যোগ করে বলেন, ‘মলয় ভৌমিক অনেক দিন থেকেই লিখছেন। তবে ম্যাওসংকেত্তন গায়ে-গতরে নয়, চিন্তায় ও গভীরতায় আরও তীক্ষ্ণ হয়েছে।’

হাসান আজিজুল হকের এই বক্তব্যের সমর্থনে সারা নাটকেই প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। চরিত্রের নামকরণের ক্ষেত্রে বর্তমান বিশ্বের দুই পরাশক্তির কর্ণধারকে কটাক্ষ করার প্রমাণ মেলে। যেমন একজনের নাম ডুয়েল পাম্ফ তো অন্যজনের নাম ভেবেনিন যতিন।

নাটকটি রচনার পাশাপাশি নির্দেশনাও দিয়েছেন নাট্যকর মলয় ভৌমিক নিজেই। দর্শকপূর্ণ মিলনায়তনে অভিনয়কালে অতীতে তাঁর আলোচিত সব নাটকের মতোই এই নাটকেও দর্শক শেষ পর্যন্ত আঠার মতো লেগে ছিলেন। ঘটনার বাঁকে বাঁকে বারবার করতালি দিয়ে তাঁরা উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। নাটকের কাহিনি বর্ণনায় বর্তমান মোড়ল রাষ্ট্রগুলোর চরিত্র ফুটে উঠেছে। ঋষিকেশ তাঁর ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছেন না। ম্যাও সেজে ভয় দেখানোর অভিযোগে ইঁদুর মোড়ল তাঁকে আটকে রেখেছেন। কিন্তু দেখা গেল ঋষিকেশের ছেলে গেছোকে আটকে রাখার পরও ‘ম্যাও’-এর ভয় যাচ্ছে না। স্বয়ং মোড়লও এতে আক্রান্ত হচ্ছেন। করণীয় খুঁজতে গিয়ে ধর্মগুরু, বুদ্ধিজীবী, যুবসমাজ, গণমাধ্যমকর্মীসহ অন্যেরা যেসব কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছেন, তাতে একদিকে যেমন হাসির উদ্রেক হচ্ছে, অন্যদিকে সন্তানহারা ঋষিকেশের হাহাকার দর্শকদের মনে বেদনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই হাহাকার ইরাক, সিরিয়া, মিয়ানমারসহ সারা বিশ্বের বেদনাহত মানুষের যন্ত্রণাকে যে স্পর্শ করছে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এই নাটকটি রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ব্যঙ্গরসাত্মক কবিতা ‘জুতা আবিষ্কার’-এর কাহিনিকে মনে করিয়ে দেয়। কবিতায় সমস্যার সমাধান চিন্তায় ১৯ পিপা নস্য শেষ হয়ে যায়। শেষে একজন মুচি তার সমাধান দিয়ে দেন। এই নাটকেও সমাধান দেন একজন স্বশিক্ষিত সাধারণ নাগারিক ঋষিকেশ, তবে এই নাটক এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। আটক গেছোর পালিয়ে যাওয়ার সময় ফেলে যাওয়া চিরকুট সমাজের বোধের দরজায় ধাক্কা দেয়। চিরকুটে গেছো বলছে: মোড়ল বাবু, আসল ম্যাও লুকিয়ে আছে আপনাদের অন্তরের লোভের মধ্যে। আপনাদের ভেতরের ম্যাওই টেনে এনেছে বাইরের ম্যাওদের—গেছোদের করেছে বন্দী নিয়মের খাঁচায়। যেখানে গেছোরা আজ দিশাহীন। কিন্তু গেছোরা আবার ফিরে আসবে—ফিরে আসবে আপনাদের লোভের গলায় ঘণ্টা ঝোলানোর জন্য।

নাটকের নির্মাণ-প্রক্রিয়ায় নির্দেশক আধুনিক নাট্য আঙ্গিকের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যের আঙ্গিকগুলোর মিশেল ঘটাতে মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। নাটকে সংগীতের ব্যবহার পরিমিত কিন্তু অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এতে রবীন্দ্রসংগীতের সুর থেকে শুরু করে বাংলা নাট্যের পুঁথিপাঠ, কীর্তন, পাঁচালীর সুরের ধারা যেমন খুঁজে পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় যাত্রা আঙ্গিকেরও মিশেল। পোশাকে ইঙ্গিতপূর্ণ রঙের ব্যবহারের নৈপুণ্য নাটকের পাত্র-পাত্রীদের শ্রেণি, পেশা ও বয়সের পার্থক্যকে দর্শকদের কাছে অর্থপূর্ণ করে তুলেছে। মঞ্চ পরিকল্পনা ও দ্রব্যসামগ্রীর ব্যবহার নিরাভরণ। অভিনেতাদের দেহ, অভিব্যক্তি ও কণ্ঠের সুদক্ষ ব্যবহারে প্রকৃতপক্ষে মঞ্চে অন্য কিছু আছে কি নেই, তা দর্শকদের ভাবায় না। এ ক্ষেত্রে নির্দেশকের সাম্প্রতিক নাট্যনির্মাণের নিজস্ব ধারারই প্রকাশ ঘটল ম্যাওসংকেত্তনের মঞ্চায়নের মাধ্যমে। দেখা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে নাট্যকার মলয় ভৌমিক তাঁর নিজস্ব নির্মাণরীতি দাঁড় করাচ্ছেন তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্যকে অবলম্বন করে। যে বৈশিষ্ট্যগুলোকে তিনি বলছেন, যেকোনো স্থানে অভিনয়যোগ্য, সহজ বহনযোগ্য ও স্বল্প ব্যয়ে নাটক নির্মাণ—যা তিনি গ্রহণ করেছেন ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্য আঙ্গিক থেকে।

নাটকের আলোক পরিকল্পনা ছিল চমত্কার কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে আরও সচেতন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কয়েকটি স্থানে আলোর প্রয়োগ-ব্যর্থতা নাটকের গতি ও ছন্দকে ব্যাহত করে। অভিনেতারা যে নাটকের ব্যাপারে স্বল্প অভিজ্ঞ এবং বয়সে তরুণ, তা তাঁদের অভিনয়দক্ষতা দেখে মনে হয়নি।

নাটকের নৃত্য পরিকল্পনা করেছেন ল্যাডলী মোহন মৈত্র, মঞ্চ পরিকল্পনায় মনির উদ্দিন ও কনক কুমার পাঠক, সংগীতে শৌভিক রায়, আলোক পরিকল্পনায় আল জাবির ও পোশাক পরিকল্পনায় ছিলেন শম্পা বিশ্বাস।

ম্যাওসংকেত্তন নাটকটি আগামী ২৬ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাতটায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হবে।