নিজেদের মতো করে গল্পটা বলতে চাই

কয়েক বছর ধরেই শোরগোল। টিভি নাটক নাকি গাড্ডায় পড়ে গেছে। দর্শকেরা বলেন, ওফ! বিজ্ঞাপন। নির্মাতারা বলেন, বাজেট কম, এজেন্সি ঝামেলা। তবে ভালো নাটক কি আসেনি? গত বছর পুরোনো ও নতুন নির্মাতারা বেশ কিছু ভালো নাটক ও টেলিছবি দর্শকদের উপহার দিয়েছেন। বিকেল বেলার পাখি, চিকন পিনের চার্জার, কথা হবে তো,বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভাল কিংবা বড় ছেলেসহ বেশ কিছু নাটক মানুষ দেখেছে। গত বছরের আলোচিত ও তরুণ কজন নির্মাতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তর্ক-বিতর্ক, হতাশা-সম্ভাবনার কথা চলল প্রথমআলোর কার্যালয়ে চায়ের আড্ডায়। তাঁদের মুখোমুখি হয়েছিলেন শরীফ নাসরুল্লাহ

গত বছর নাটকের তথৈবচ অবস্থায়ও কিছু নির্মাতা নজর কেড়েছেন। তাঁদের মধ্য থেকে কয়েকজন হাজির এই আড্ডায়। সবার মুখে একটাই কথা শোনা গেল, ‘নিজের মতো করে গল্পটা বলতে চাই।’ তা যে ফরমেটেই হোক না কেন। একটা সময় ছিল, যখন সবাই টেলিভিশনের নাটক দিয়েই সন্তুষ্ট থাকত। কিন্তু এখন প্রযুক্তির কল্যাণে বিভিন্ন মাধ্যম তৈরি হয়েছে। নির্মাতারা ভাবছেন নিজেদের গল্পটি বলার সেরা মাধ্যমের কথা। হতে পারে তা ফিকশন, ডকুফিকশন, প্রামাণ্যচিত্র কিংবা নতুন কোনো কিছু। চলচ্চিত্র নিয়ে পড়েছেন নির্মাতা জাহিন ফারুক আমিন। অস্থির সময়ের স্বস্তির গল্পে শ্যাওলা দিয়ে হাতেখড়ি। তাতেই বাজিমাত। বললেন, ইউরোপসহ নানা জায়গায় নির্মাতার পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। একেকটা গল্প একেক মাধ্যমে বলা হচ্ছে। চাই তা টেলিভিশনে প্রচার হোক কিংবা ওয়েবে।

বিজ্ঞাপন আর নাটক নির্মাণ: পেশাদারি

কিন্তু এ দেশের টেলিভিশনের নাটক এখনো পড়ে আছে আগের ধারায়। তার মাঝে বিজ্ঞাপন আর এজেন্সির চাপে নির্মাতারা ঠিক নিজেদের কাজটি করে উঠতে পারছেন না। তবে পথ কী? বড় ছেলে টেলিছবির নির্মাতা মিজানুর আরিয়ান বললেন, ‘বাজেট একটা বড় বিষয়। বাজেট বাড়লে প্রযোজনাও ভালো হয়। তাঁর সঙ্গে প্রযোজকের উচিত হবে নির্মাতাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া। বেশি বেশি বিজ্ঞাপন দেওয়াও বন্ধ করতে হবে।’ নাটক নির্মাণের দিক থেকে এই নির্মাতা ‘সিনিয়র’। এখন অবধি ৪৫টি নাটক নির্মাণ করেছেন।

নির্মাতা হুমায়ূন সাধু মাথা নাড়িয়ে বোঝান তিনি এ কথার সঙ্গে একমত। যুক্তও করতে চান কিছু। চিকন পিনের চার্জার (নাটকের নাম) দিয়ে পরিচিত এই নির্মাতার ভাষায়, স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারলে একসময় নির্মাতা কাজ করার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেন। অন্য কিছু করার সুযোগ খোঁজেন।

হুমায়ূন সাধুর কথার প্রমাণ মেলে আরেক নির্মাতার কথায়। তিনি বলেন, ‘এখন অনেক নির্মাতাই আছেন, যাঁরা বিজ্ঞাপন নির্মাতা হিসেবে পরিচিতি। অথচ তাঁদের ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল টেলিভিশন নাটকের মাধ্যমেই।’

প্রশ্ন চলে আসে, তবে নির্মাতারা কেন ঝুঁকছেন বিজ্ঞাপন ইন্ডাস্ট্রিতে? মাইক্রোফোনের কাছে এগিয়ে আসেন নির্মাতা কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়। ফুল ফোটানোর খেলা নাটক দিয়ে পরিচিতি তাঁর। বললেন, ‘বিজ্ঞাপন ইন্ডাস্ট্রিতে যেভাবে পেশাদারি চর্চা গড়ে উঠেছে, টিভি নাটকে ঠিক সেই পেশাদারিত্ব নেই। একটা সময় ছিল, যখন টিভি নাটকেও এই পেশাদারিত্ব ছিল। তখন বাজেট বলেন, বিজ্ঞাপন বলেন—এগুলো কোনো সমস্যা হিসেবে সামনে আসেনি।’

মনে পড়ে কোথাও কেউ নেই, সংশপ্তক, অয়োময়-এর মতো জনপ্রিয় নাটকগুলোর কথা। সত্যিই কি তবে পেশাদারির জায়গাটা একেবারেই ফাঁকা? উদাহরণ দিয়ে একজন নির্মাতা বললেন, একটা চরিত্রের জন্য যে ‘হোমওয়ার্কটা’ করতে হয়, একজন অভিনেতা সেই সময়টা দিচ্ছেন না। এটা যে একতরফা তাদের দোষ তা-ও নয়। নির্মাতাকেও কম বাজেটে অল্প সময়ের মধ্যে কাজটা করতে হয়। পুরো সিস্টেমেই এই অপেশাদার সংস্কৃতিটা গড়ে ‍উঠেছে। তবে কেউ যে একেবারেই পেশাদার নন, এমনটি কিন্তু না।

দরকার নাপ্ল্যাটফর্ম

কথা হবে তো? নাটক দিয়ে সরব নির্মাতা সৈয়দ আহমেদ শাওকী। নির্মাতাদের সারির ঠিক শেষের দিকে চুপচাপ বসে। মাইক্রোফোন চলে যায় তাঁর কাছে। একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, ‘কথা একটাই, প্রযোজকদের সৃজনশীল হতে হবে। নির্মাতারা নানা মাধ্যমে নিজেদের গল্পটি বলার চেষ্টা করছেন। প্রযোজকেরা কি এগুলোর সঙ্গে পরিচিত?’

প্রথম আলোর আমন্ত্রণে এসেছিলেন ছয় তরুণ নির্মাতা। বাঁ থেকে: জাহিন ফারুক আমিন, সৈয়দ আহমেদ শাওকী, তানভীর আহসান, হুমায়ূন সাধু, মিজানুর আরিয়ান ও কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়। ছবি: খালেদ সরকার
প্রথম আলোর আমন্ত্রণে এসেছিলেন ছয় তরুণ নির্মাতা। বাঁ থেকে: জাহিন ফারুক আমিন, সৈয়দ আহমেদ শাওকী, তানভীর আহসান, হুমায়ূন সাধু, মিজানুর আরিয়ান ও কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়। ছবি: খালেদ সরকার

সৈয়দ আহমেদ শাওকীর কথার সঙ্গে তাল মেলালেন নির্মাতা তানভীর আহসান। বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভাল নাটকটি তাঁকে দর্শকের মনের কাছে নিয়ে এসেছে। বললেন, ‘অন্যান্য অনেক প্ল্যাটফর্ম তৈরি হচ্ছে। ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, আইটিউনস এখানে শিগগির আসছে, দেশি ওয়েব প্ল্যাটফর্ম তৈরি হচ্ছে। সেখানে বিশ্বমানের কাজ না হলে হবে না। টেলিভিশনকেও তাদের সঙ্গে লড়তে হবে।’

আলাপ চলতে থাকে। বাইরে তখন ১১ ডিগ্রি তাপমাত্রা। জাঁকানো শীত যাকে বলে। ধূমায়িত চায়ে চুমুক দেন নির্মাতারা। তাঁদের আলাপের সার করলে দাঁড়ায়, আগে দর্শকের কাছে বিনোদনের একটি মাধ্যম ছিল। এখন টেলিভিশন ছেড়ে আরও নানা মাধ্যম মানুষের হাতের মুঠোয় চলে গেছে। তারা বিদেশি বিভিন্ন ঘরানার প্রযোজনার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। চ্যানেলগুলো শুধু তাদের টিভি ফিকশনের ধারাটি দিয়েই টিকে থাকতে পারবে না। তাদের নানামুখী (ভার্সেটাইল) হতে হবে। বিশ্ব এখন বিভিন্ন ধারায় প্রযোজনা বানায়। প্রযোজকদেরও এটা বুঝতে হবে। বিষয়টি যদি টেলিভিশন কিংবা চ্যানেল মালিকেরা না বোঝেন, তবে বড়সর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। নির্মাতার কাছে ফিকশন বানানোর নানা মাধ্যম হাজির হচ্ছে খুব শিগগির।

তবে এর জন্য জানাশোনার কোনো বিকল্প নেই। নির্মাতা কৃষ্ণেন্দুর মতে, দেশে চলচ্চিত্রের জন্য ভালো কোনো ইনস্টিটিউট নেই। চলচ্চিত্র হোক কিংবা ‘টিভি ফিকশন’, সব মাধ্যমের জন্যই পড়ালেখা প্রয়োজন। তবেই ভালো পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, অভিনয়শিল্পী ও কারিগরি লোকজন তৈরি হবে। ঘষেমেঝে আর চলছে না। পুরোনো ধারাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নতুন নতুন ধারায় কাজ করতে হবে।

অন্য নির্মাতারাও কৃষ্ণেন্দুর কথার সঙ্গে একমত। তাঁর সঙ্গে যোগ হলো এইটুকু, বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করলে হবে না। এভাবে একজন তারেক মাসুদ পাওয়া যাবে ঠিকই, কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়াবে না। এর জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ইনস্টিটিউট করতে হবে। সেখানে বাইরে থেকে অভিজ্ঞদের এনে শেখাতে হবে। বিশ্বের নতুন নতুন ধারার সঙ্গে পরিচিত হতে হবে নির্মাতাসহ প্রযোজক, অভিনয়শিল্পী সবার।

বলে রাখা ভালো, একসময় চেয়ারম্যানবাড়ির জানালার পাশে ভিড় জমত টিভি নাটক দেখতে। এখন চেয়ারম্যানবাড়ির জানালার পাশে সেই ভিড় নেই। নাটক চলে গেছে আসমানে। ইন্টারনেট দিয়ে দুনিয়া এখন সবার হাতের মুঠোয়। মুহূর্তেই ভিডিও স্ট্রিমিং ওয়েবসাইট কিংবা ইউটিউব দুনিয়া দিয়ে ঢুঁ মেরে দেখে আসা যায়। শুধু মাধ্যম যে বদলে গেছে তা তো নয়। নাটকের গতরও পাল্টেছে। পরিবর্তন এসেছে রুচিতেও।

তিন ক্যামেরা দিয়ে ইনডোরে সেটের মধ্যে তৈরি হতো টিভি নাটক। একদল তরুণ তাকে টেনে নিয়ে এলেন বাস্তব জগতে। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন নতুন নতুন ধারার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন নির্মাতারা। তাঁদের উদ্যমী চোখে পরিবর্তনের আভাস। ‘ফিকশনকে’ রূপ দেবেন নতুন কোনো ধারায়। নতুন বছরে তবে সম্ভাবনা কী? নির্মাতাদের ভাষায়, টেলিভিশনেরও এখন নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল চালু করছে। একই প্রযোজনা দিয়ে দুভাবেই আয় করা যাচ্ছে। ফলে বেড়ে যাবে বাজেট। নির্মাতারাও স্বাধীন হতে পারবেন। নিজেদের মতো করে বলতে পারবেন নিজেদের গল্পগুলো।