যেখানেই থাকো, চিরশান্তিতে থাকো

শাম্মী আখতার (জন্ম: ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৫— মৃত্যু: ১৬ জানুয়ারি ২০১৮)
শাম্মী আখতার (জন্ম: ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৫— মৃত্যু: ১৬ জানুয়ারি ২০১৮)

শাম্মী নেই। আমি বিশ্বাস করব কীভাবে? সময় বয়ে যায়, জানি। কিন্তু আমার যে মনে হয়, এই তো সেদিন, আমার বাসায় শাম্মী-আকরামের বিয়ে দিলাম। উপস্থিত ছিলেন খোন্দকার নূরুল আলম, সত্য দা (সাহা), অজিত দা (রায়), নুরুজ্জামান দুলাল, সুবীর নন্দী এবং আকরামের সিলেটের কয়েকজন বন্ধু। আমিই কন্যাকর্তা, আমিই উকিল বাবা।

৯ জানুয়ারি আমি মা হারিয়েছি। সেই শোক কোনো দিনই কাটিয়ে উঠতে পারব না। তারই মধ্যে ১৬ তারিখ, বিকেল চারটার কিছু পরে যশোর বসেই খবর পেলাম, ‘শাম্মী এইমাত্র চলে গেল।’ ধক করে উঠল বুকের ভেতর। আমি মা হারিয়েছি, কোমল (শাম্মীর ছেলে) মা হারাল। কোমল এখন মস্ত চাকরি করে। কিন্তু মাঝখানের সময়টা যে কবে কবে পেরিয়ে গেছে, বুঝতেই পারিনি।

কত কথা, কত স্মৃতি! কয়েকটি পরিবারের প্রায় এক পরিবার হয়ে ওঠা—আমার পরিবার, খোন্দকার ভাইয়ের পরিবার, সত্যদার পরিবার, শাম্মী-আকরামের পরিবার, রফিকুল আলম-আবিদা সুলতানার পরিবার, সুবীর নন্দী, দুলালের পরিবার—কখনো আমার বাসায়, কখনো খোন্দকার ভাইয়ের বাসায়, কখনো সত্যদার বাসায় সমবেত হয়ে সংগীতসহ কত খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টার আড্ডা। এর পরে যোগ হয়েছিল শাকিলা এবং সুলতানা চৌধুরীসহ আরও অনেক শিল্পী।

মনে পড়ে, ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের উদ্যোগে সারা দেশ থেকে প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পীদের ঢাকায় নিয়ে এসে গান রেকর্ড করানো। শাম্মীও ছিল তাদের একজন। তাদের মধ্যে যারা বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, শাম্মী আখতার তাদেরই একজন। এই নতুন শিল্পীদের জন্য তখন একের পর এক গানের কবিতা লিখেছি। লিখেছেন আরও অনেকেই। নতুন শিল্পীর কণ্ঠে গান দাঁড়াবে কি দাঁড়াবে না, আমরা তা একবারও চিন্তা করিনি। কিন্তু আমাদের সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে তাদের গান মানুষের হৃদয়ে স্থান করেছে। শুধু আমরা নই, বড় মাপের সুরস্রষ্টা প্রায় সবাই শাম্মীকে দিয়ে গান করিয়ে প্রত্যাশিত ফল পেয়েছেন।

আধুনিক বাংলা গানের ভুবনে তখন ওই নতুন শিল্পীরা এক নবজাগরণের সৃষ্টি করে। চলচ্চিত্রেও তারা সফল হয়, দারুণভাবে। শেখ সাদী খানের সুরে, ‘ভালোবাসলেই সবার সঙ্গে ঘর বাঁধা যায় না’ গানটির জন্য শাম্মী জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। শাম্মী আখতার ব্যক্তিগতভাবে আমার ছোট বোন। আমার কোনো বোন না থাকায়, শাম্মী সেই শূন্যস্থানটা অধিকার করে নিয়েছিল নিজের গুণেই। ওর চিরবিদায়ের খবর শুনে, আকরামুল ইসলামকে ফোন করে তার বুকভাঙা কান্না শুনে, নিজেকে স্থির রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সম্ভব-অসম্ভব এমন কিছুই নেই, যা সে তার ভালোবাসার শাম্মীর জন্য করেনি। কী সান্ত্বনা দিতে পারতাম আমি তাকে? নেই, কোনো সান্ত্বনা নেই, আকরামের জন্য, কোমলের জন্য। সান্ত্বনা হিসেবে গৎবাঁধা কিছু কথা বলতে পারিনি আমি। পারব না কোনো দিন।

আমাদের বাংলা গানের জগতের সবচেয়ে শান্ত-সুশীল মেয়েটি আর নেই। এটাই চিরসত্য। তবু সে বেঁচে থাক তার গানে, অনন্তকাল, এটাই কামনা। শাম্মী, যেখানেই থাকো, চিরশান্তিতে থাকো।

লেখক: গীতিকবি