লক্ষ্যাপার: সুরে-কুয়াশায় একাকার

লক্ষ্যাপারের পরিবেশনা
লক্ষ্যাপারের পরিবেশনা

‘সবকিছু দেখে-শুনে আমি তো অবাক...যাদের বড় কোন স্পনসর নেই, অর্থলগ্নিকারী নেই, তারা কীভাবে এত সুন্দর একটা ক্লাসিক্যাল অনুষ্ঠান করে? ওখানে পৌঁছবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পরিষ্কার হলো বিষয়টা; আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, যত্ন আর নিখাদ পরিশ্রম দিয়ে গড়া লক্ষ্যাপারের এই আয়োজন। এখানে উপস্থিত প্রত্যেক শ্রোতারই আলাদাভাবে লক্ষ্যাপারের মানুষের এই ভালোবাসার ছোঁয়া পাওয়া হয়ে যায়।’ বলছিলেন এই প্রথম লক্ষ্যাপারের রাতভর গানের আসরে ঢাকা থেকে যোগ দিতে যাওয়া একজন শ্রোতা। সত্যি তাই। এ রকম সব মানবিক সম্পদ কাজে লাগিয়েই লক্ষ্যাপার পাড়ি দিয়ে ফেলল ‘নয় নয় করে’ নয় বছরের পথ।

বাংলার অসামান্য সংগীতসাধক বারীণ মজুমদারকে উত্সর্গ করা এবারের আয়োজন সাজানো হয়েছিল দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালায়। প্রথম দিন নারায়ণগঞ্জের প্রিপারেটরি স্কুল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় শাস্ত্রীয় সংগীত প্রতিযোগিতা, যার মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হয় নতুন বছরের জন্য কে কে হবে ‘হারাধন-সুখেন শাস্ত্রীয় সংগীত প্রাণোদনা বৃত্তি’র অধিকারী।

নারায়ণগঞ্জ ক্লাব কনভেনশন সেন্টারে দ্বিতীয় দিনের শুরুতে ছিল ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজন ‘বাহাস’—তলস্তয়ের ক্রেইৎজার সোনাটা নভেলাকে আশ্রয় করে ‘সাহিত্যে সংগীত’ নিয়ে আলোচনা। বিকেল ৫টার এই পর্বে অধ্যাপক মানস চৌধুরী, জগলুল আসাদ ও অমল আকাশ যুক্তি তর্ক গপ্পে মাতিয়ে তোলেন সবাইকে।

অনেক প্রতীক্ষার রাতভর গানের আসর শুরু হয় রাত আটটায়। লক্ষ্যাপার পরম্পরার শিক্ষার্থীদের সমবেত পরিবেশনা ‘অষ্ট-কল্যাণ’-এর বৈচিত্র্যময় সুরে ভরে ওঠে নারায়ণগঞ্জ ক্লাব কনভেনশন হল। এরপর ‘পুরিয়া ধানেশ্রী’ রাগে খেয়াল শোনান বেঙ্গল স্কলার কানিজ সিমপী। মিলনায়তনে তখন তিন শতাধিক মানুষের সমাগম। শুরু হয় ‘লক্ষ্যাপার আজীবন সম্মাননা’ প্রদান। শিল্পী ও সংগীতবিশারদ আজাদ রহমান সম্মাননা গ্রহণ করে প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এখানে না এলে আমার জীবন অপূর্ণ রয়ে যেত।’

প্রীতিভোজের বিরতির আগে মঞ্চে এসে ‘চন্দ্রকোষ’ রাগে শ্রোতাদের উদ্বেলিত করেন আহমেদ ব্রাদার্স নাম পাওয়া তিন সহোদর—সবুজ আহমেদ (তবলা), শান্ত আহমেদ (বেহালা) ও কামরুল আহমেদ (বাঁশি)। পণ্ডিত তুষার দত্তের ‘গোরক কল্যাণ’ রাগে খেয়ালের পর অতিচেনা সুরের শিবরঞ্জনী দাদরায় চোখ ছলছল করে ওঠে অনেকের। পণ্ডিত বিপ্লব ভট্টাচার্যের অনবদ্য তবলা সংগতে চতুরঙ্গী যন্ত্রে ‘কিওয়ানি’ বাজিয়ে শোনান তরুণ শিল্পী সোমরঞ্জন চক্রবর্তী। রেজোয়ান আলীর ‘গুর্জরি টোড়ি’ বড় মায়া জাগায়। শেষ শিল্পী অর্ণব ভট্টাচার্য ‘বৈরাগী’র রূপায়ণের মধ্য দিয়ে জানিয়ে দেন সারা পৃথিবীকে মোহিত করতে প্রস্তুত তাঁর সরোদ। সকাল সাড়ে ছয়টায় পৌষের কুয়াশার মতো সুরে আচ্ছন্ন হয়ে বাড়ি ফেরেন শ্রোতারা। সার্থক লক্ষ্যাপারের নবম সম্মিলন।