উত্তর-আধুনিক বাঙালি মনের দোসর

সুবচন নাট্য সংসদের প্রণয় যমুনা নাটকের দৃশ্য
সুবচন নাট্য সংসদের প্রণয় যমুনা নাটকের দৃশ্য

ঢাকার সুবচন নাট্য সংসদের নতুন নাটক প্রণয় যমুনার অভিনয় হলো কলকাতার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে। ২৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যাবেলায়, অনীকের গঙ্গা-যমুনা নাট্যোৎসবের পালে হাওয়া তোলে। মনে আছে, এই অনীকেরই ডাকে সুবচনের মহাজনের নাও দেখেছিল কলকাতা, ঠিক পাঁচ বছর আগে। এই অ্যাকাডেমিতে। সেবার শাহ আবদুল করিমকে আধার করে ঝিলমিল ঝিলমিল জলে ময়ূরপঙ্খী নাও ভেসেছিল। এবার বৈষ্ণব পদাবলিতে ভর করে যমুনা পুলিনে রাইকানুর লীলাকীর্তন হলো। যাত্রাপথের কর্ণধার একই। সুদীপ চক্রবর্তী।
দশক দুই আগে রাধাকৃষ্ণ নামে একটা আখ্যায়িকা লিখেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তাতে রাধাকৃষ্ণর আধ্যাত্মিক প্রেমকে লৌকিক প্রেমের জবানে তরজমা করে নিয়েছিলেন সুনীল। পূর্ব রাগ থেকে রাধা বিরহের চেনা গতে বাঁধা হলেও তার মধ্যে বর্ণবাদী শ্রেণিবৈষম্যের খেই ধরিয়ে দিয়েছিলেন। নক্ষত্র কুলবধূর সঙ্গে গোপকুলতলিকের প্রেমের নানান পর্বের মধ্যে আটপৌরে ভালোবাসার সুতো বুনেছিলেন। এর থেকে আসাদুল ইসলাম যে নাটক লিখেছেন, তাতে চণ্ডীদাস জ্ঞান দাসের পদের সঙ্গে মণিকাঞ্চন যোগ ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের। জীবনানন্দের হাত ধরে আজকের প্রেমহীন পৃথিবীর মধ্যে সাঁকো গড়া হয়েছে। আমিরুল ইসলাম যে সুর করেছেন, তাতে প্রচলিত সুরের আদল নিয়ে নতুন সুরের জাল বোনা হয়েছে। এসব কিছুকে কতক পালাকীর্তনের আদলে সাজিয়ে নিয়েছেন সুদীপ। কথক আর গায়েনের তালে দোহারকি দিয়েছেন ব্রজবাসীগণ। পেছন থেকে পাশ থেকে খোল, ঢোল, বাঁশি, বেহালা, হারমোনিয়াম বেজেছে। সুবচনের নটনটীরা সবাই কমবেশি গাইতে পারেন, নাচতে পারেন, বাজাতেও পারেন। তেলেজলে হয় না। ফলে রসোপলব্ধি হলো, রস নিষ্পত্তিও হলো। বাংলাদেশের আধুনিক মঞ্চনাটক কেমন করে অখণ্ড বাংলার শেকড়ে বয়ে চলা পারফর্মিং আর্টের গাঙে নাও ভাসিয়েছে, তাকে উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রসেনিয়ামের মাপে গড়েছে, উত্তর-আধুনিক বাঙালি মনের দোসর করেছে, প্রণয় যমুনা তার নমুনা হয়ে উঠল। আমাদের নাট্য যে আদতে দৃশ্যকাব্য, গোড়ায় ছবি আর কবিতার সার পড়লে তা যে কল্পনার পালে ভাসতে ভাসতে অনেক দূরের পাড়ি ধরতে পারে, তা-ও আরেকবার দেখিয়ে দিল।
এ যাত্রায় প্রণয় যমুনার পারানি হয়েছে তার মরমি চলন। সুদীপ যে মঞ্চসজ্জা করেছিলেন, তাতে আপ স্টেজের দুপাশ থেকে ঝুলে থাকা ফুলপাতার নকশাকাটা চওড়া দুটি সাদা থান ছাড়া ছিল এক কাঠের পাটাতন, প্রসেনিয়ামের কিনার বরাবর। তার আড়ালে বাজনদারের দল। তার দুপাশে পাটাতনে উঠে যাওয়ার ঢাল। সেই ঢাল ওই পাটাতনের দুই ধারে কানা উঁচু করে বসাতেই দিব্য এক নৌকো হয়ে গেল, মাঝামাঝি মিলে গিয়ে দোচালা বসতবাড়ির চেহারা নিল। পাটাতনের কোল বরাবর, বৃন্দা-বিশাখা-ললিতা-রাধার মেটে কলসের ওপর পদ্মপাতা আর জল এঁকে দিলেন শামীম চিত্রকর। তাতে ভেসে রইল জেগে রইল পাখপাখালি, গাছগাছালি। অশেষ সাহার নকশা করা পোস্টারে, গর্গ আমিনের নরম আলোর টানে নদীমাতৃক সভ্যতার এসব সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান আমাদের চোখে কাজলের মতো লেগে রইল। বেশভূষায় এমনিতে একটা সহজিয়া চাল ছিল। আঁটোসাঁটো সাদা জামা, ঢিলেঢালা পায়জামা তাতে মিশ না খেলেও অন্যান্য মঞ্চসামগ্রীর মনোহারিত্বে, বিশেষ করে মণিপুরি আঙ্গিকের মাপা প্রয়োগে সেসব চাপা পড়ে গেল।
সুবচনের কুশীলবেরা দল বেঁধে হাল ধরতে জানেন। সুরের দোলায় তাল মিলিয়ে অমিত চৌধুরী যে দেহভঙ্গিমা ছকে দিয়েছিলেন, তার ভেতরে এক সহজিয়া ছাঁদ ছিল। আহাম্মেদ গিয়াস, মেহেদি হাসানকে সামনে রেখে এই সহজিয়া চাল মঞ্চজুড়ে আলপনা দিল। দাপিয়ে বেড়াল না। পূর্ব রাগের বর্ণনায় দুই পদকর্তাকে যখন মিলিয়ে মিশিয়ে নেওয়া হলো, তখন আমাদের চোখে কানে কোনো ঠোকাঠুকি লাগল না। প্রণয় যমুনার অভিনয়রীতিতে সূক্ষ্ম অভিব্যক্তির যেটুকু জায়গা ছিল, সেটুকু উসুল করে নিলেন লিঠু মণ্ডলের মতো পাকা অভিনেত্রী। কৃষ্ণ হলেন ফজলুল হক। আড়াল থেকে তাঁর হয়ে আড়বাঁশি বাজালেন এম এ কে সোহান। এমন মধুর রসায়ন তৈরি হলো যে আলাদা করা দায়। রাধা বিরহের তুমুল মুহূর্তে সোনিয়া হাসান সুবর্ণার চোখের কোল ছাপিয়ে যখন জল এল, বাংলার ভাঙা বুকের পাঁজর থেকে যেন একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল। যুগল মিলনের দৃশ্যে পাদপ্রদীপের আলো বিশাল ছায়া ফেলল সাইক্লোরামার বুকে। এই উপমহাদেশের অনেক দিনকার সমন্বয়ী চৈতন্যের অনেক পরত ছুঁয়ে গেল এই দৃশ্য নির্মাণ।
মঙ্গলকাব্য বা গীতিকা নিয়ে বাংলাদেশ অনেক উল্লেখযোগ্য নবনাট্যের পরীক্ষা করেছে। পদাবলিকে পুঁজি করে এমন নাটক আরও মহত্তর সৃষ্টির ধাপ রয়ে রইল। সুবচন ও সুদীপ চক্রবর্তীর যুগলবন্দীর কাছে আমাদের চাহিদা আরও বেড়ে গেল।