এক মঞ্চ এক নারী

>

কোকিলারা, বিনোদিনী, গোলাপজান কিংবা কহে বীরাঙ্গনা—একক অভিনয়ের নাটকগুলোর নাম শুনলে যাঁদের মুখ ভেসে ওঠে, তাঁদের সিংহভাগই নারী। নিজের একক অভিনয়কৌশলে দর্শকদের মোহিত করেছেন রাতের পর রাত। বাংলাদেশের মঞ্চনাটকে এ এক ইতিহাস বটে। নারী দিবসের এই দিনে বেশ কিছু একক নাটক নিয়ে থাকল এবারের আয়োজন।


‘বিনোদিনী’ শিমূল ইউসুফ

বিনোদিনী দাসীর আত্মজীবনী আমার কথাআমার জীবন থেকে রচিত হয়েছে নাটক বিনোদিনী। উপমহাদেশের বিখ্যাত এই অভিনেত্রীকে মঞ্চে রূপায়ণ করেছেন শিমূল ইউসুফ। বর্ণনাত্মক রীতিতে রচিত নাটকটি বাংলাদেশের মঞ্চনাটকে এক অনবদ্য প্রযোজনা। নাটকের বিষয়টি যেমন বিখ্যাত, তেমনি শিমূল ইউসুফের অসাধারণ অভিনয় দিয়েছে অন্য মাত্রা। এটির প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল ২০০৫ সালে।


তিনি ‘গোলাপজান’

পুরান ঢাকার এক সাধারণ নারী গোলাপজানের সংগ্রামী কাহিনি নিয়ে নাটক গোলাপজান। পুঁজিবাদী সমাজে ঢাকায় গোলাপজানের শৈশব-কৈশোর, যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছানোর সংগ্রামী জীবনের আখ্যান এটি। গোলাপজানের চরিত্রটিতে মঞ্চে সাড়াজাগানো অভিনয় করেছিলেন রোকেয়া রফিক। এখনো অভিনীত হচ্ছে নাটকটি।


‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ নাটকে লাকী ইনাম

ড. নীলিমা ইব্রাহিমের লেখা আমি বীরাঙ্গনা বলছি বইয়ের সাতটি গল্পের একটি নিয়ে লেখা নাটক আমি বীরাঙ্গনা বলছি। নির্দেশনা, অভিনয় করেছেন লাকী ইনাম। নাটকের গল্প একজন পরিপূর্ণ নারীর। যাঁর বিয়ে হয়েছে, সন্তান আছে। কিন্তু তাঁকে মাঝেমধ্যে ভয়ংকর সব স্মৃতি তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। বিভিন্ন সময়ে লিখে রাখা দিনলিপি দর্শকদের পড়ে শোনান। সঙ্গে সঙ্গে ফিরে যান ভয়ংকর সব স্মৃতিতে। নাগরিক নাট্যাঙ্গন বাংলাদেশের প্রযোজনা এটি।

‘কোকিলারা’র ফেরদৌসী মজুমদার

ভারতীয় অভিনয়শিল্পী তৃপ্তি মিত্রের অপরাজিতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ফেরদৌসী মজুমদার। কখনো ভাবেননি একক অভিনয়শিল্পী হিসেবে তিনিও মঞ্চ আলোকিত করবেন। কিন্তু আবদুল্লাহ আল মামুন আচমকাই কোকিলারা নাটকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। ফেরদৌসী বলেছিলেন, ‘অসম্ভব, এ পারব না।’ কিন্তু আবদুল্লাহ আল মামুন হাল ছাড়েননি। বলেন, ‘সংলাপগুলো মুখস্থ করুন। আপনি পারবেন না তো কে পারবে?’ ফেরদৌসী মজুমদারও সংলাপ মুখস্থ করতে দিন-রাত লেগে পড়েন। স্মৃতিচারণা করছিলেন, ‘আমার বাড়িতে একটা নতুন কাজের মেয়ে আসে। সে দেখে, আমি ঘরের দরজা হালকা লাগিয়ে সংলাপ মুখস্থ করছি। উঠছি, বসছি, আয়নার সামনে দাঁড়াচ্ছি। এটা দেখে ও ভয় পেয়ে অন্য কাজের মেয়েকে বলছে, “এই বাসার বেগম সাহেবার কি মাথা ঠিক আছে?”’

মাস তিনেকের মধ্যে একেবারেই ঠোঁটের আগায় সংলাপ। মহড়া চলে। ১৯৮৯ সালে প্রথমবারের মতো পাদপ্রদীপের আলোয় দাঁড়ালেন একা, একক অভিনয়শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার। এরপর তো ইতিহাস। সোয়া দুই ঘণ্টার নাটক। একাই তরতর করে এগিয়ে যান শেষ সংলাপ পর্যন্ত। কোন বিষয়টি একক অভিনয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ? বলছিলেন, ‘কয়েকটি নাটক দেখেছেন নবীনদের। তাঁরা চেষ্টা করেছেন যথেষ্ট। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভালো পাণ্ডুলিপি। এটি ভালো না হলে যত বড় অভিনয়শিল্পীই হোক, ক্ষমতা নেই দর্শক ধরে রাখে। সঙ্গে সঙ্গে একক অভিনেত্রীর দর্শনধারী ও ব্যক্তিত্বও দরকার। আবদুল্লাহ আল মামুন বলেছিলেন, “একক অভিনয়শিল্পীদের প্রথম দেখাতেই ভালো না লাগলে দর্শক ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।”’


‘ফুলরানী আমি টিয়া’ নাটকে মুনিরা ইউসুফ

১০০ বছর আগে সমাজে নারীর অবস্থান ছিল শোচনীয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হতো। বর্তমানেও পুরুষতান্ত্রিক আচরণের পরিবর্তন তেমন একটা হয়নি। নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলেও স্বাধীন হতে পারেনি পুরোপুরি। প্রতিনিয়ত তাকে লড়াই করতে হচ্ছে। এমন বিষয় নিয়ে একক নাটক ফুলরানী আমি টিয়া। একক অভিনয় করেছেন মুনিরা ইউসুফ। ২০০৬ সালে মঞ্চে আসে। প্রদর্শনী হয়েছে ২৫টি।


‘লাল জমিন’ নিয়ে মোমেনা চৌধুরী

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একক অভিনয়ের নাটক লাল জমিন। নাটকটিতে অভিনয় করে মোমেনা চৌধুরী বেশ প্রশংসায় ভাসেন। শূন্যন নাট্যদল থেকে তৈরি হয়েছে নাটকটি। ২০১১ সালে মঞ্চে আসে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ দেশের বাইরের বিভিন্ন স্থানে নাটকটির মঞ্চায়ন হয়। মুক্তিযুদ্ধের এ কাহিনি শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে মঞ্চায়িত হচ্ছে কলেজে ও স্কুলেও।


পাঁচ নারীর চরিত্রে রোজী সিদ্দিকী

পাঁচ নারীর গল্প নিয়ে ঢাকা থিয়েটারের নাটক পঞ্চনারী আখ্যান। পাঁচ নারীর চরিত্রেই অভিনয় করেছেন রোজী সিদ্দিকী। ২০১২ সালে নাটকটি মঞ্চে আসে। নারী অভিনয়শিল্পীদের জন্য অপার সম্ভাবনা ও সুযোগ দেখছেন রোজী সিদ্দিকী। বলেন, হাতে গোনা কয়েকটি একক প্রযোজনা পুরুষের। বাকিগুলোতে নারীরা অভিনয় করেছেন। তবে নারীর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের পাশে দাঁড়ানোকেও ইতিবাচক দেখছেন তিনি। একক অভিনয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সাহস।


‘সীতার অগ্নিপরীক্ষা’য় নাজনীন চুমকী

২০১০ সালের শেষের দিকে মঞ্চে আসে সীতার অগ্নিপরীক্ষা। সাধনার প্রযোজনা। রামায়ণের কাহিনিকে মঞ্চে তুলে আনেন নাজনীন চুমকী। মঞ্চে কখনো তিনি সীতা, কখনো তিনি রাম কিংবা অন্য কোনো চরিত্র। একক অভিনয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন চরিত্র রূপান্তরকে চ্যালেঞ্জ মনে হয় নাজনীন চুমকীর কাছে।


‘স্ত্রীর পত্র’ নিয়ে ফেরদৌসী আবেদীন

জিয়নকাঠির একক নাটক স্ত্রীর পত্র। নির্দেশনায় বিপ্লব বালা। নাটকটিতে একক অভিনয় করেছেন ফেরদৌসী আবেদীন। ২০০৩ সাল থেকে নাটকটি মঞ্চায়িত হয়ে আসছে। প্রদর্শনী হয়েছে ২৫টি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্ত্রীর পত্র’ অবলম্বনে এটি তৈরি হয়েছে।


মাইকেলের কাব্য নিয়ে জ্যোতি সিনহা

দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা, অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী, জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা ও নীলধ্বজের প্রতি জনার চিঠি নিয়ে নাটক কহে বীরাঙ্গনা। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ নিয়ে এটি তৈরি। নারী চরিত্রগুলো মঞ্চে তুলে এনেছেন মণিপুরী থিয়েটারের অভিনয়শিল্পী জ্যোতি সিনহা। ২০১০ সালে নাটকটি মঞ্চে আসে। অভিনয়ে নারীদের টিকে থাকা নিয়ে বলেন, নারীরা বেশি দিন পর্যন্ত কাজ করতে পারছে না। এটা একটা বড় প্রতিবন্ধকতা।


‘গহনযাত্রা’য় শামছি আরা

পদাতিক নাট্য সংসদ থেকে ২০১৬ সালে মঞ্চে আসে গহনযাত্রা। উগ্রপন্থীদের হাতে ক্ষতবিক্ষত সমাজ। সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচে সালমা। চলে উগ্রপন্থীদের বিপরীত পথে। এমনই নাটকটির মূলকথা। সালমার চরিত্রটি করেছেন শামছি আরা সায়েকা। একক নাটকে ভুলগুলো নিজের ওপরই বর্তায়। ভালো ও খারাপ দুটোর দায়ই নিজের কাঁধে পড়ে।


‘নভেরা’রূপী সামিউন জাহান

ভাস্কর নভেরাকে নিয়ে মঞ্চ আখ্যান নভেরা। মঞ্চে নভেরা হিসেবে দেখা দেন ঢাকা থিয়েটারের অভিনয়শিল্পী সামিউন জাহান। ২০১৬ সালে মঞ্চে এনেছে ধ্রুপদি অ্যাক্টিং অ্যান্ড ডিজাইন। সামিউন জাহানের মতে, পুরো নাটকে একা অভিনয় করাটা একটা দক্ষতার ব্যাপার। তা ছাড়া মঞ্চ অভিনয়ের ক্ষেত্রে নারীর জন্য সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যায়নটা তেমন হচ্ছে না।