হলিউডে যেভাবে নগ্নতা আসে

হলিউডের চলচ্চিত্রে এভাবে নবাগত নারী অভিনেত্রীদের তো বটেই, অনেক সময় প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রীদের নগ্ন দৃশ্যে অভিনয়ের জন্য জোরজবরদস্তি করা হয় বলে অভিযোগ। নবাগত হলে অবস্থা হয় বেশি বেগতিক। ছবি: রয়টার্স
হলিউডের চলচ্চিত্রে এভাবে নবাগত নারী অভিনেত্রীদের তো বটেই, অনেক সময় প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রীদের নগ্ন দৃশ্যে অভিনয়ের জন্য জোরজবরদস্তি করা হয় বলে অভিযোগ। নবাগত হলে অবস্থা হয় বেশি বেগতিক। ছবি: রয়টার্স

অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্রের মূল নায়ক হিসেবে স্টিভেন সিগালের বেশ সুনাম আছে। তাঁর বেশির ভাগ সিনেমায় তিনিই থাকেন মূল চরিত্রে। ২০০৭ সালে ‘ফ্লাইট অব ফিউরি’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। সেই ছবিতে নবাগত অভিনেত্রী হিসেবে কাজ পেয়েছিলেন সিয়েরা পেটন। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৮ বছর। নবাগত বলেই নির্ধারিত চিত্রনাট্যে না থাকা নগ্ন দৃশ্যে অভিনয় করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।

হলিউডের চলচ্চিত্রে এভাবে নবাগত নারী অভিনেত্রীদের তো বটেই, অনেক সময় প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রীদের নগ্ন দৃশ্যে অভিনয়ের জন্য জোরজবরদস্তি করা হয় বলে অভিযোগ। নবাগত হলে অবস্থা হয় বেশি বেগতিক। সে ক্ষেত্রে নগ্ন দৃশ্যে অভিনয়ে রাজি না হলে কখনো কখনো কোনো কারণ ছাড়াই খোয়াতে হয় কাজ। আবার অন্য পরিচালকদের কানেও ওই অভিনেত্রীর দুর্নাম ছড়ানো হয়।

‘ফ্লাইট অব ফিউরি’তে অভিনয়ের জন্য সিয়েরা পেটনকে যেতে হয়েছিল রোমানিয়া। পরে পেটন জানতে পারেন, শুধু নগ্ন দৃশ্যে অভিনয় করার জন্যই নাকি তাঁকে ছবিটিতে নেওয়া হয়েছিল! ছবিটি সিয়েরা পেটনের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া
‘ফ্লাইট অব ফিউরি’তে অভিনয়ের জন্য সিয়েরা পেটনকে যেতে হয়েছিল রোমানিয়া। পরে পেটন জানতে পারেন, শুধু নগ্ন দৃশ্যে অভিনয় করার জন্যই নাকি তাঁকে ছবিটিতে নেওয়া হয়েছিল! ছবিটি সিয়েরা পেটনের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

‘ফ্লাইট অব ফিউরি’তে অভিনয়ের জন্য সিয়েরা পেটনকে যেতে হয়েছিল রোমানিয়া। উড়োজাহাজ থেকে নেমেই শুটিং স্পটে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, চিত্রনাট্যে না থাকলেও স্নানের পর সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হবে তাঁকে। এ নিয়ে আপত্তি জানালে, স্বয়ং স্টিভেন সিগাল সিয়েরাকে জিজ্ঞেস করে বসেন, ‘তুমি কি কোমর পর্যন্তও দেখাবে না?’ পরে পেটন জানতে পারেন, শুধু নগ্ন দৃশ্যে অভিনয় করার জন্যই নাকি তাঁকে ছবিটিতে নেওয়া হয়েছিল!

দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের এক খবরে বলা হয়েছে, নগ্ন বা প্রায় নগ্ন দৃশ্যে অভিনয়ে নবাগত অভিনেত্রীদের বাধ্য করা হয়। এমন একাধিক অভিনেত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্যারিয়ারের শুরুতে একজন নারী শিল্পীর তেমন কোনো প্রভাব থাকে না। শুটিং স্পটে বা পরিচালকদের কাছে তাঁরা মতামত জানাতে পারেন না। এ ছাড়া হলিউডে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার তাড়নাও থাকে। অনেকে মনে করেন, যদি নগ্ন দৃশ্যে অভিনয়ে না করা হয়, তবে হয়তো বাদ পড়ে যাবেন! কেউ কেউ কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার আশঙ্কাও করেন। এমন প্রভূত মানসিক চাপ ও শুটিং স্পটের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশের কারণে, সায় না থাকলেও নগ্ন হয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে বাধ্য হন তাঁরা।

দ্য ইকোনমিস্টের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, হলিউডের সিনেমায় এখন আর রেললাইনে নায়িকাদের বেঁধে রাখা হয় না। তাঁকে উদ্ধারে দৌড়ে আসে না নায়ক। কিন্তু তাই বলে হলিউডি ছবিতে নারীদের গুরুত্ব বাড়েনি। এই একবিংশ শতাব্দীতেও একঘেয়ে চরিত্রেই অভিনয় করতে হচ্ছে বেশির ভাগ অভিনেত্রীদের। এখনো বেশি সংলাপ বরাদ্দ থাকে অভিনেতার জন্য। আর অভিনেত্রীদের খসাতে হয় কাপড়। এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, কারণ হলিউডে বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে পুরুষদের হাতে।

তবে হলিউড সব সময় নগ্নতার ওপর নির্ভরশীল ছিল না। বিংশ শতাব্দীর প্রথম কয়েক দশক হলিউডে নগ্নতার বিষয়ে একধরনের আরোপিত সেন্সরশিপ ছিল। এর কারণ হলো ওই সময়ে জারি থাকা মোশন পিকচার প্রোডাকশন কোড। তাতে নগ্ন দৃশ্যের ব্যাপারে কিছু কড়াকড়ি ছিল। ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি এই আগল খুলে যায়। তখন ওই কোড শিথিল করা হয়। এতে চরিত্রের প্রয়োজনে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নগ্ন হতে আর বাধা রইল না।

কিন্তু পুরুষ ও নারীদের ক্ষেত্রে নগ্নতার এই নিয়ম সমানভাবে কার্যকর হয়নি। এখানেও আছে বৈষম্য। ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে একটি জরিপে পাওয়া তথ্য জানানো হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যানেবার্গ ইনক্লুশন ইনিশিয়েটিভ ২০১৬ সালে এই জরিপ চালায়। তাতে দেখা গেছে, ওই বছরে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করা ১০০ চলচ্চিত্রে অনেক বিখ্যাত অভিনেত্রী অভিনয় করেছেন। এঁদের মধ্যে নগ্ন দৃশ্যে অভিনয় করতে হয়েছে ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ অভিনেত্রীকে। অন্যদিকে অভিনেতাদের ক্ষেত্রে এটি মাত্র ৯ দশমিক ২ শতাংশ। আর হলিউডে পুরুষ ও নারী শিল্পীদের মধ্যে এই ব্যবধান নতুন কিছু নয়। জরিপে বলা হয়েছে, ২০০৬ সাল থেকে চিত্রটি এমনই।

হলিউডে টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংগঠন হলো এসএজি-এএফটিআরএ। নগ্ন দৃশ্যে অভিনয়ের ক্ষেত্রে এই সংগঠনটির বেশ কিছু নিয়মকানুন রয়েছে। এর মধ্যে অ্যালায়েন্স অব মোশন পিকচার ও টেলিভিশন প্রযোজকদের সঙ্গে মুলোমুলি করার অধিকারও কলাকুশলীদের দেওয়া হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, নগ্ন দৃশ্যের কথা অডিশনের আগেই সংশ্লিষ্ট শিল্পীকে জানাতে হবে এবং শিল্পীর লিখিত সম্মতি পেতে হবে। কিন্তু এগুলো দেখভালের জন্য কোনো কর্তৃপক্ষ নেই।

তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব ন্যূনতম নিয়ম মানা হয় না হলিউডে। লস অ্যাঞ্জেলেসভিত্তিক একটি বিনোদন-সংক্রান্ত আইনি প্রতিষ্ঠানের অংশীদার লোন ড্যাং ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ‘এগুলো একেবারেই ন্যূনতম কিছু নিয়ম। নগ্ন দৃশ্যের বিষয়ে এর বাইরে গিয়েই আলোচনা চলে।’ তিনি আরও বলেন, বেশির ভাগ সময় মৌখিক চুক্তির মাধ্যমে এগুলো ঠিক হয়। আর শিল্পীর সঙ্গে এই চুক্তি হয় পরিচালক বা প্রযোজকের।

গত বছরের শেষের দিকে মিরাম্যাক্স ফিল্মসের প্রতিষ্ঠাতা হার্ভি ওয়াইনস্টিনের বিরুদ্ধে ওঠে একাধিক যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ। গড়ে ওঠে #মিটু আন্দোলন। ছবি: এএফপি
গত বছরের শেষের দিকে মিরাম্যাক্স ফিল্মসের প্রতিষ্ঠাতা হার্ভি ওয়াইনস্টিনের বিরুদ্ধে ওঠে একাধিক যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ। গড়ে ওঠে #মিটু আন্দোলন। ছবি: এএফপি

গত বছরের শেষের দিকে মিরাম্যাক্স ফিল্মসের প্রতিষ্ঠাতা হার্ভি ওয়াইনস্টিনের বিরুদ্ধে ওঠে একাধিক যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ। গড়ে ওঠে #মিটু আন্দোলন। অনেকে এখন বলছেন, শুধু প্রযোজক নয়, পরিচালকেরাও নগ্ন দৃশ্যে অভিনয়ের জন্য নারী শিল্পীদের বাধ্য করেন। হলিউডের একজন উঠতি অভিনেত্রী বেনিতা রোবলেদো। ‘গসিপ গার্ল’, ‘টিন ওলফ’ ও ‘হোয়্যাট হ্যাপেনস ইন ভেগাস’ নামের কিছু সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। এখন পরিচালক হওয়ার চেষ্টায় আছেন বেনিতা। তিনি বলেন, ‘যখন আপনি শুটিং সেটে থাকবেন, তখন দেখবেন সবকিছুই চলছে পরিচালকের ইশারায়। সেখানে তিনিই সর্বেসর্বা। আর তাঁর কথামতো কাজ করতে না পারলে আপনি হবেন অপদার্থ।’

বেনিতা জানান, ২০১৬ সালে মাইকেল ডেভিড লিঞ্চের পরিচালনায় একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। পরিচালক তাঁকে একটি নগ্ন দৃশ্যে অভিনয়ের জন্য জোরাজুরি করতে থাকেন। পরে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় তাঁকে দেখানো হবে না—এই শর্তে রাজি হন বেনিতা। কিন্তু সিনেমার প্রথম প্রদর্শনীতে পর্দায় নিজেকে পুরোপুরি নগ্ন অবস্থায় আবিষ্কার করেন বেনিতা রোবলেদো। এ নিয়ে হাজার দেনদরবারের পর নতুন করে দৃশ্য ধারণ করতে রাজি হয়েছিলেন পরিচালক মাইকেল। তবে তার আগে নানা অশালীন কথা শুনতে হয়েছিল বেনিতাকে।

কিন্তু এখন কেন এসব অভিযোগ উঠছে? আগে কেন বলেননি অভিনেত্রীরা? ভুক্তভোগী সিয়েরা পেটন জানান, তাঁর মতো পরিস্থিতিতে যেন অন্য কারও পড়তে না হয়, সে জন্যই মুখ খুলেছেন তিনি। সিয়েরা বলেন, ‘নারীদের চুপ করে থাকার শিক্ষা দেওয়া হয়। আমি সরব হতে চেয়েছি।’

হলিউডে ধারণা করা হয়, নারীপ্রধান চলচ্চিত্র চলে না। কিন্তু ‘ওয়ান্ডার ওমেন’ সর্বাধিক ব্যবসাসফল ছবির তালিকায় উঠে আসায়, এই বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। ফাইল ছবি
হলিউডে ধারণা করা হয়, নারীপ্রধান চলচ্চিত্র চলে না। কিন্তু ‘ওয়ান্ডার ওমেন’ সর্বাধিক ব্যবসাসফল ছবির তালিকায় উঠে আসায়, এই বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। ফাইল ছবি

বদলাচ্ছে হলিউড?
হার্ভি ওয়াইনস্টিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠার পর থেকে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছে হলিউডে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, #মিটু আন্দোলন এ পরিবর্তনের প্রধান কারণ। এ কারণে অন্যান্য কর্মস্থলের মতো হলিউডের হাওয়াও বদলাচ্ছে।

দ্য ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, পুরুষ সর্বস্ব হলিউডে এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় আসছেন নারীরা। বড় বাজেটের সিনেমাতেও এ কাজ হচ্ছে। ধীরে ধীরে প্রধান চরিত্র, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সম্পাদনা প্রভৃতি বিভিন্ন ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে নারীদের। সম্প্রতি অস্কার অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো শ্রেষ্ঠ পরিচালক ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেয়েছেন একজন নারী। সিনেমেটোগ্রাফিতেও একজন নারী মনোনয়ন পেয়েছেন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, হলিউডের ক্ষমতায় ভারসাম্য আনছে #মিটু। অনেক নারীকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ পরিচালনার সুযোগ পাচ্ছেন সহজে। অন্যদিকে ছবির বিষয়বস্তু হিসেবে যৌনতা বা সহিংসতাকে গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক খুঁতখুঁতে হয়ে উঠছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো।

হলিউডে একটি বিশ্বাস প্রচলিত আছে, নারীপ্রধান চলচ্চিত্র বাজারে চলে না। কিন্তু ‘ওয়ান্ডার ওমেন’ উত্তর আমেরিকার সর্বাধিক ব্যবসাসফল ছবির তালিকার তিনে উঠে আসায়, এই বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। একইভাবে ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’-এর ধুন্ধুমার ব্যবসা কৃষ্ণাঙ্গ কলাকুশলীদের বিষয়ে থাকা নেতিবাচক ভাবনাকে বদলে দিয়েছে।

ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, হলিউডের বড় বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন নারী লেখক ও পরিচালকদের গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেছে। এসব লেখক ও পরিচালকেরা নতুন নতুন নারী চরিত্র সৃষ্টি করছেন। আর এটি সম্ভব হয়েছে হার্ভি ওয়াইনস্টিনের মতো ক্ষমতাধরদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের কারণে। যদি এ আন্দোলনের ফলাফল এমন ইতিবাচকই হতে থাকে, তবে যৌন নিপীড়নের এসব ভয়ংকর ঘটনার একধরনের ‘মধুর সমাপ্তি’ অপেক্ষা করছে।