দিতি আপা, এমন অপরাধ করতে নেই!

দিতি
দিতি

তখন আমি কলেজ বয়। বয় মানে পাকনা বয়। ইংলিশ আর বাংলা মুভি সিনেমা হলে গিয়ে দেখি। হিন্দি দেখি ভিসিআরে। বাংলা কমার্শিয়াল মুভি তখন বউ-বাচ্চা নিয়ে সবাই দেখতে যায়। সিনিয়রদের মধ্যে শাবানা-ববিতা-কবরী-সুচরিতাদের পাশাপাশি হঠাৎ ফ্ল্যাশলাইটের মতো উদয় হন চম্পা আর দিতি নামের দুই কাটা তলোয়ার। কলেজ বয় থেকে প্লেবয়, সবার বুকের কাঁপুনি। ইংলিশে বলে হার্টথ্রব। আর ওদিকে তখন পর্দায় ‘নাগিন ড্যান্স’, চিৎকার আর শিস খেতে খেতে একাই সারা দেশে ভূমিকম্প তুলছে ওজনদার অঞ্জু ঘোষ!

ফুটপাতে তখন নায়িকাদের রঙিন ভিউকার্ড বিক্রি হয়। দাম ২ টাকা। খুব জনপ্রিয় এই ভিউকার্ড। বন্ধু পাপ্পুর হাতে দেখি ৪টা ভিউকার্ড। ৮ টাকায় কিনেছে। একেকটা উঁচু করে ধরে ধরে এক্স-রে ফিল্মের মতো দেখছে। সুচরিতা, ববিতা, চম্পা, দিতি। বললাম, ‘আমারে একটা দে।’ চম্পারটা আলাদা করে রেখে বলল, ‘যেইটা ইচ্ছা নে।’ আহ, বেঁচে গেলাম। টান মেরে দিতিকে নিলাম। উঁচু করে ধরে চেয়ে আছি। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। পাপ্পু আশ্চর্য। বলল, ‘কাহিনি কী রে? হাঁপাস ক্যান?’

কাহিনিটা বললাম।

ছোটকালে পাশের বাসার বন্ধুর মামাতো বোন বেড়াতে এসেছিল। দেখে টাশকি খেয়েছিলাম। এত্ত কিউট? মেয়েটা বুঝে গিয়েছিল। আমার দিকে চোখ পড়লেই ঠোঁট বাঁকিয়ে লাইটপোস্টের দিকে তাকাত। আর দিতিকে দেখে সেই টাশকিটাই খেলাম। সেই চমকে দেওয়া মামাতো বোনের ফটোকপি! সেই ফেস, সেই রং, সেই তিল, সেই হাসি। পাপ্পু বলল, ‘ওই পিচ্চি দিতিটারে প্রপোজ করসিলি তখন?’ বললাম, ‘মাথা খারাপ? খাড়ার ওপরে চটকানা মাইরা দিত!’ বলল, ‘কই থাকত ছেরিডা?’ বললাম, ‘ম্যানিলা, ফিলিপাইন।’ দুঃখে মাথা নিচু করে পিঠে সান্ত্বনার হাত রেখে বলল, ‘মন খারাপ করিস না, ফিলিপাইনের দিতি না পাইলেও বাংলাদেশের দিতি তো পাইছোস। টিকিট কাইটা দেখলেই হইব।’

হ্যাঁ, পেয়েছিলাম বাংলাদেশের দিতি আপাকে। বহু বহু বছর পর। যখন নাট্যকার আর তা থেকে নাট্যকার-নির্মাতা হয়ে যাই। এক ঈদের নাটকে কাস্ট করব। প্রথম পরিচয়ে নার্ভাস ছিলাম। ফিলিপিনো নার্ভাসনেস। মুহূর্তে তা উধাও হলো। মিষ্টি মিশুক হাসিতে আপন করে নিলেন তিনি। বুঝে নিলাম, স্ক্রিপ্টের মতো আমাকে মানুষ হিসেবেও অপছন্দ করেননি।

দিতি
দিতি

আশুলিয়ার এক গ্রামে শুটিং। ফরীদি ভাইয়ের বউয়ের চরিত্র। হুমায়ুন ফরীদি। আমাকে ভীষণ স্নেহ করেন ফরীদি ভাই। দিতি আপাকে দেখে গম্ভীরভাবে বললেন, ‘কী খবর?’ দিতি আপা ঐতিহাসিক সেই মিষ্টি হাসিতে বললেন, ‘কখন আসছেন?’ প্রথম ধাক্কা খেলাম দিতি আপার গেটআপ আর কস্টিউম দেখে। আমি কল্পনায় যা লিখেছি, উনি তা-ই হয়ে এসেছেন। কথাই ছিল, বাসা থেকে রেডি হয়ে আসবেন। আমি বললাম, ‘হোল্ড অন।’ দাঁড়ালেন দিতি আপা। আপাদমস্তক মাপছি। ফরীদি ভাই গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘আরে ঠিক আছে পাগলা।’ ফরীদি ভাই আমাকে আদর করে ‘পাগলা’ ডাকতেন। আজব হয়ে লক্ষ করলাম, সারা দিন দিতি আপার মুখে খুশির একটা হাসি লেগেই আছে। সুখ সুখ হাসি। কারণ অজানা।

লাঞ্চের সময় দিতি আপাকে খুঁজছি। পাচ্ছি না। পেলাম এক কুঁড়েঘরে। শুটিংয়ের লাঞ্চ রেখে গ্রামের নারীরা যা রেঁধেছে, তা একটু একটু কালেক্ট করে প্লেট সাজিয়েছেন। টাকি মাছের ভর্তা, ট্যাংরা মাছের চচ্চড়ি, লাউ চিংড়ি। প্লেট হাতে ফিসফিসিয়ে বললাম, ‘ট্যাংরা মাছগুলো যা সুন্দর!’ বললেন, ‘আমার হাতেরটা খাবা?’ দুষ্টুমি করে বললাম, ‘তোমার হাতে খাব মানে?’ হেসে বললেন, ‘চটকানা দিব। বলছি আমার হাত লাগছে। খাবা?’ বললাম, ‘হোয়াই নট?’ তিনি হাত দিয়ে তুলে হাফ ট্যাংরা চচ্চড়ি আমার প্লেটে দিলেন। তিনি বোঝেননি, ওটা ছিল আমার কাছে এক মহামূল্যবান ফিলিপিনো ডিশ।

ওনার গুলশানের কনসোর্টিয়াম দিতি’স ফ্ল্যাটে ঢুকলেই হাতের ডানে লিভিং স্পেস। পুরো ফ্ল্যাট চমৎকার করে সাজানো। নিজেই করেছেন। লিভিং স্পেসে তিনি আর আমি খোশগল্পে। নতুন ড্রাইভার ঢুকল। আমাকে দেখেই উচ্ছ্বাসে বলল, ‘স্যার সালাম। কেমন আছেন?’ অবাক দিতি আপা বললেন, ‘চেনো নাকি?’ ড্রাইভার বলল, ‘আমি স্যারের “ভোলার ডায়রি”তে অভিনয় করছি।’ চিৎকার করে দিতি আপা বললেন, ‘শায়ের, দুনিয়ার সবাই কি তোমার নাটকে অভিনয় করেছে?’ বললাম, ‘সবাই করেনি, এখনো অনেক বাকি আছে।’

ছেলেমেয়েকে অসম্ভব নজরে রাখতেন। ছেলে তখন স্কুলে পড়ে। এইট-নাইনে হবে। ঢুকে আমাকে সালাম দিল। বড়দের সালাম দেওয়ার কার্টেসিটা বাচ্চাদের ভালোভাবেই রপ্ত করিয়েছেন। উঠে গেলেন, আর ফিরে এলেন। মনে হলো, ছেলেকে না বুঝতে দিয়ে কিছু শুঁকে এলেন। জিজ্ঞেস করায় বললেন, ‘ছেলে বড় হচ্ছে। বাইরে থেকে এসেছে। সিগারেটের গন্ধ আছে কি না দেখলাম। বয়সটা খারাপ। ভয় হয়, শায়ের।’ মনে মনে বললাম, অর্গানিক মা।

দিতি
দিতি

আম্মা মারা গেলে আমাদের বাসায় মিলাদে আসেন দিতি আপা। সাদা সালোয়ার-কামিজ, চওড়া দোপাট্টায় মাথা ঢেকে। এত ভিড়ে কেউ টের পেল না, দিতি এলেন, মিলাদ পড়লেন, চলে গেলেন। ড্রেস কোড জানতেন। আ রিয়েল স্মার্ট লেডি।

আম্মা মারা যাওয়ার আগে আগে আমার একটা নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি। নাম ‘সুরেলা ফাঁদ’। এক সন্ধ্যায় দিতি আপা আর আমি দুজনই ফ্রি। মানে শুটিং নেই। আড্ডার কথা বলে বাসায় গেলাম। উদ্দেশ্য ছিল অন্য। সেই নাটকের পেমেন্টটা বাকি, সেটা দেব। গল্পে মজে গেলেন। মেষ রাশির জাতিকারা সাধারণত জীবনের নাটকীয় ও আবেগপূর্ণ ঘটনাগুলো বিশ্বস্ত মানুষকে বলতে পছন্দ করে। বলে গেলেন জীবনকাহিনি। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলাম। একটা কথা শুনে ভীষণ চিন্তিত হলাম। জাস্ট কয়েক দিন আগে তিনি বিদেশ (দেশের নাম মনে নেই) থেকে এসেছেন। প্লেনে নাকি টানা নয় ঘণ্টা অচেতন ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন ঘুমিয়েছেন, কিন্তু কেবিন ক্রুরা তাঁকে বলেছেন, তিনি অচেতন ছিলেন। তার মৃত্যুর কারণ ব্রেইন টিউমারের সঙ্গে এই অচেতনতার কোনো লিংক আছে? কী জানি? ডাক্তাররা বলতে পারবেন। এটা ২০০৪-২০০৫ সালের ঘটনা।

বাড়ি ফিরব। পেমেন্ট দিতে গেলে তিনি পেমেন্ট নেবেন না। নেবেনই না। সম্ভবত আম্মা মারা যাওয়ায় আমার জন্য এক্সট্রা মায়া হয়েছে। নাম না বলে এক ফিল্ম প্রডিউসারের কথা বললেন। বললেন, অনেক আগে সেই প্রডিউসারের কাছে মুভিতে অভিনয়ের ১০-১২ লাখ টাকা পেমেন্ট বাকি ছিল। কিন্তু মুভিতে লসের পর লস খেয়ে বেচারার খুব খারাপ অবস্থা। তিনি মাফ করে দিয়েছিলেন পাওনা সেই ১০-১২ লাখ টাকা। বললাম, ‘আমি তো পেমেন্ট দিতে এসেছি, মাফ নিতে না।’ প্রস্তুত ছিলেন না তিনি এই উত্তরের।

দিতি আপা, তুমি আমাকে মাফ করতে পারোনি, আমিও তোমাকে মাফ করব না। এই অসময়ে চলে যাওয়াটা একেবারেই উচিত হয়নি। এটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এ অপরাধ করতে হয় না!