বাস্তবের জালে স্বপ্নের সুন্দর

স্বপ্নজাল ছবির একটি দৃশ্য
স্বপ্নজাল ছবির একটি দৃশ্য

গিয়াস উদ্দিন সেলিমের স্বপ্নজাল ভালো ছবি, ‘সুন্দরতম’ বাংলাদেশি ছবিগুলোর একটি। জনপ্রিয় ধারার ছবির মধ্যে এখন পর্যন্ত আমার কাছে সবচেয়ে নিটোল ছবি মনে হয়েছে স্বপ্নজালকে।

স্বপ্নজাল ‘ফেস্টিভ্যাল মুভি’ নয়। এটা কিন্তু প্রশংসা। দর্শকদের ভালো লাগবে এ রকমই একটা ছবি বানাতে চেয়েছেন সেলিম এবং তাতে তিনি সফল হয়েছেন। আমি নিজে নাটক-চলচ্চিত্রের জন্য গল্প লিখি, কাজেই আমার সর্বপ্রথম বিচার্য গল্প। সেলিমের এই ছবির খুবই ভালো দিক হলো, মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই গল্প ক্লাইম্যাক্সে ঢুকে যায়, দর্শকের চোখ পর্দায় আঠার মতো আটকে যেতে বাধ্য হয়। এরপরে কী, এরপরে কী? শেষ দৃশ্য পর্যন্ত এই কৌতূহল সেলিম ধরে রাখতে সমর্থ হন।

এরপর প্রশংসা করতে হবে কিসের? অভিনয়ের, নাকি ক্যামেরার? একজনের চেয়ে আরেকজন ভালো অভিনয় করেছেন, কাকে ছেড়ে কার কথা বলব! ফজলুর রহমান বাবু। কিন্তু ইরেশ যাকেরই বা কম করলেন কী! এমনকি মিশা সওদাগর, এমনকি শহিদুল আলম সাচ্চু। আস্তে আস্তে। পরিমনি যে পাশের বাসার কিশোরীটি হয়ে উঠতে পারেন, মেকআপ ছাড়া দিব্যি স্বচ্ছন্দ অভিনয় করতে পারেন, এই অভাবনীয় কাণ্ডটা ঘটেছে এই ছবিতে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়েছেন ইয়াশ। এই ছবির একটা বৈশিষ্ট্য মিশা সওদাগর কিংবা সাচ্চুকে ইতিবাচক চরিত্রে দেখা। আর ছবির মন্দ মানুষটি, ফজলুর রহমান বাবু। তিনি গতানুগতিক ছবির ভিলেনের মতো পেশল নন, ভঙ্গুর। অপরাধ করে আবার ভোগেন অপরাধবোধে—সে এক চরিত্রই বটে।

ছবির দৃশ্যায়ন আগাগোড়া সুন্দর। আর সুন্দর শিল্পনির্দেশনা। চাঁদপুরের পত্রিকা, চাঁদপুরের ক্যালেন্ডার, পুরোনো ফোনসেট—কোনো কিছুই দৃষ্টি এড়ায়নি নির্দেশকের।
এই সিনেমার বাইরের গল্পটা প্রেমের। কিশোর-কিশোরীর প্রেম। অপু+শুভ্রা। কিন্তু ভেতরের গল্পটা? বৃহত্তর সম্প্রীতির। কবির ভাষায়: ‘ভালোবাসায় ভুবন করে জয়, সখ্যে তাহার অশ্রুজলে শত্রুমিত্র হয়, সে যে সৃজন-পরিচয়।’ এই পৃথিবীতে শান্তি আনতে পারে তো কেবল ভালোবাসাই। এই ছবি খুব গোপনে সেই বোধটা সঞ্চারিত করে দর্শকের মর্মতলে।
ছবির শেষ দৃশ্য দেখে আমার চোখ ভিজে আসছিল। শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ বসে ছিলাম।
আর বেরোতে বেরোতে ভাবছিলাম, বাহ! বাংলাদেশের ছবি এত ‘সুন্দর’ও হয়!

পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সেলিম
পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সেলিম

গিয়াস উদ্দিন সেলিমের সেরা কাজ এটি। মনপুরা মাথায় রেখেই বলছি। এই ছবিতে একটা দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি আপনাদের খেয়াল করতে বলব, শুভ্রারা দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে পোষা পাখিটা পড়শিকে দিয়ে যায়, ফেরার পরে সেটা আবার হস্তান্তরিত হয়। আমার তো মাহমুদুল হকের কালো বরফ-এর কথা মনে পড়ছিল। আরও একটা স্মরণীয় নাট্যমুহূর্তের কথা বলি, নিজে বিষ খেয়ে ফেলে ইরেশ যাকের গলা টিপে ধরেছেন ফজলুর রহমান বাবুর, তারপর দুজনেই স্তব্ধ। তারপর?
কেন বলব? হলে গিয়ে ছবি দেখুন।

স্বপ্নজাল-এ কোনো ভুল নেই? ভুল ছাড়া সিনেমা হয় নাকি! টাইটানিক-এও তো এক পিস্তল থেকে সাতটা বুলেট বেরিয়েছিল। আমি স্বপ্নজালকে নিটোল ছবিই বলব। তবু বলতে পারি, সেলিম, দেওয়ানি আর ফৌজদারি উকিল আলাদা হন, আর বাদী আর বিবাদীর উকিল অভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা চাঁদপুরের মতো শহরে কম। যদি তা ঘটেই, সংলাপে তাকে সিদ্ধ করে নিতে হতো।
স্বপ্নজাল আমাকে সুন্দরের জালে পেঁচিয়ে ফেলেছে, আমি তাকে পারি না এড়াতে। জনে জনে ডেকে বলি, ভাই এবং বোন, দয়িতা এবং প্রিয়তা, স্বপ্নজাল দেখতে যান। ভালো লাগবে।
আনিসুল হক সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক