আমরা কেবল কতগুলো বছর উদ্যাপন করছি না

আলী যাকের
আলী যাকের

প্রশ্ন: নাগরিকের ৫০ বছর, দর্শনীর বিনিময়ে নাটক দেখার ৪৫ বছর। কোনটাকে এগিয়ে রাখবেন?
আলী যাকের: নাগরিকের ৫০ বছরের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, দর্শনীর বিনিময়ে নাটক প্রদর্শনের ৪৫ বছরকে। এটা বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। ৫০ বছর অনেক প্রতিষ্ঠানের, অনেক সমিতির হতেই পারে। কিন্তু তারা যদি নিষ্কর্মা, নির্বীর্য হয়েই থাকে, তাহলে তো সেই থাকার কোনো মানে নেই। সেদিক থেকে আমি বলব, নাগরিক যে ৪৫ বছর ধরে এখনো মঞ্চে টানা নাটকের চর্চা করে যাচ্ছে, এটিই হচ্ছে আসল কৃতিত্ব।

প্রশ্ন: গ্রুপ থিয়েটার নিয়ে চলার পথটা তো ততটা মসৃণ নয়। কীভাবে টিকে থাকা?

আলী যাকের: এমন একটা পরিস্থিতিতে আমরা নাটক করে যাচ্ছি, যখন মঞ্চ আমাদের রুটিরুজির সংস্থান করে না। রুটিরুজির জন্য অভিনয়শিল্পীদের মঞ্চের বাইরে কাজ করতে হয়। সিনেমায় করতে হয়, টেলিভিশনে করতে হয়। আমরা সৌভাগ্যবান এই জন্য যে আমরা যখন নাটকে এসেছি, তখন আমরা প্রায় প্রতিষ্ঠিত। ভালো চাকরি করি, অতএব জীবনধারণের জন্য আমাদের মঞ্চের ওপর নির্ভরশীলতা ছিল না। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কাজটি পূর্ণাঙ্গভাবে করতে পেরেছি। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো না হলে হয়তো এ ধরনের একটি কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না।

প্রশ্ন: নাগরিকের পথচলা নিয়ে সংক্ষেপে বলতে বললে কী বলবেন?

আলী যাকের: আমি যদি পেছন দিকে তাকাই, ১৯৭৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারিতে তো শুরু, সেই হিসাব মোতাবেক আমরা ৪৫ বছর নিয়মিত নাটক করে যাচ্ছি। তখন থেকে আজ পর্যন্ত কখনোই আমরা যতি দিইনি। হয়তো কোনো একটা সমস্যা এসেছে, যেমন কেউ একজন মারা গেছে কিংবা এই আমি যেমন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, এক বছরের বেশি সময় মঞ্চে উঠিইনি, কিন্তু ফিরে এসেছি আবার। সেই মঞ্চের অঙ্গনেই ফিরে এসেছি, চিন্তাটা সব সময় মাথায় ছিল। এখানেই খুব সামান্য সাফল্যও যদি থেকে থাকে, এভাবেই এসেছে।

প্রশ্ন: এত কিছু থাকতে মঞ্চনাটক কেন করলেন?

আলী যাকের: অনেকেই প্রশ্ন করেন, কেন মঞ্চনাটক করলেন? আমি এখানে বলতে চাই, অনেক আগে থেকেই লিখে আসছি, বলে আসছি, আমাদের প্রধান এবং প্রথম উদ্দেশ্য ছিল মঞ্চে নাটককে একটি নিয়মিত শিল্পমাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করা। এখানে সবকিছুই ছিল, মঞ্চে নাটক ছিল না। নাটক কোনো অনুষ্ঠানে হতো, কোনো অফিসের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হতো। পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে হতো। কিন্তু নিয়মিত শিল্পমাধ্যম হিসেবে ছিল না। এটিই ছিল আমাদের প্রথম উদ্দেশ্য। আজ হয়তো পেছন ফিরে তাকালে বলা যায়, এই কাজটিতে আমরা সফল হয়েছি।

প্রশ্ন: অনেকেই বলেন, বিদেশি নাটকের দিকেই আপনাদের দৃষ্টি ছিল বেশি।

আলী যাকের: আমাদের করা নাটক নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, পর্যালোচনা অনেক হয়েছে। একেকজন শিল্পচর্চাকে একেকভাবে দেখে। যেমন অনেকেই ভাবে, দেশজ নাটক করতে হবে, যেটাকে মৌলিক নাটক বলা হয়। এ নিয়েও কিন্তু বিতর্ক আছে। আজ এই ক্ষুদ্র পরিসরে এ নিয়ে আলোচনা করার সময় নেই। কোনো একসময় হয়তো সেমিনার হলে কথাগুলো বলব। মৌলিক আসলে কতটা মৌলিক? মৌলিক কথাটা বড় কঠিন। আমি তো পেছন ফিরে তাকালে মৌলিক নাটক দেখি সফোক্লিস, শেক্‌সপিয়ার, রবীন্দ্রনাথে। এর ফাঁক-ফোকরে আরও কয়েকজন আছেন, যেমন ইবসেন, চেখভ। মৌলিক নাটক লেখার খুব বেশি মানুষ কি আছেন? বেশির ভাগ নাটকেই কারও না কারও প্রভাব থেকে যায়।

প্রশ্ন: নাগরিকের শুরুর দিকের কথা যদি একটু বলতেন...

আলী যাকের: যখন ভেবেছি, নিয়মিত নাটক করব, নাটক খুঁজছি, তখন আমাদের এক বন্ধু গোলাম রব্বানী বলল যে আমি বাদল সরকারের লেখা বাকি ইতিহাস নামে একটি নাটক পড়েছি। নাটকটা খুব ভালো। পড়ে দেখতে পারো। পড়লাম এবং সত্যিকার অর্থেই উত্তেজিত বা চমৎকৃত হলাম। তখন কেবল আমরা বড় বড় ‘হাইসাউন্ডিং’ শব্দ নিয়ে খেলাধুলা করছি। অস্তিত্ববাদ, নাইহিলিজম, অধিবাস্তববাদ...মানুষের বেঁচে থাকার একটা কারণ থাকতে হয়, নইলে সবাই আত্মহত্যা করত। এটাই তো আলবেয়ার কামু বা সার্ত্রের দর্শন। কোনো কারণ না থাকলে বাঁচার তো কোনো কারণ নেই। সেই বিষয়টিকেই বাদল সরকার অত্যন্ত সুন্দরভাবে সম্পূর্ণ বাঙালিয়ানাভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর বাকি ইতিহাস নাটকের মধ্যে। আমরা মহড়া করতে লাগলাম। এখানে বলে রাখি, পরবর্তী পর্যায়ে এখন একজন বিখ্যাত কলামিস্ট, যার নাম উল্লেখ করতে চাই না, লিখলেন, নাগরিক শুধু বিদেশি নাটক করে বেড়ায়। ঠিক আছে, মাথা পেতে নিলাম। তিনি এ কথা লিখেছেন, যখন আমরা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের শাজাহান নাটকটি করছি। আমরা তখন সত্যিই খুঁজে চলেছি দেশজ কাজ। আমরা দেশজ কাজ যে করিনি, তা নয়। আমরা সাঈদ আহমেদের মাইলপোস্ট করেছি, সৈয়দ শামসুল হকের বেশির ভাগ কাজ, ভালো নাটক, যা তাঁর নিজস্ব নাটক হিসেবে আমরা দেখি, করেছি। নূরলদীনের সারাজীবন তো সাংঘাতিক একটা মাইলফলক, কাব্যনাটক। আমরা সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি দর্শককে আন্তর্জাতিক নাট্যধারার সঙ্গে পরিচিত করার চেষ্টা করেছি। আমরা ব্রেশটকে প্রথম বাংলাদেশের মঞ্চে এনেছি। আমাদের আগে আর কেউ করেনি। ব্রেশটের সৎ মানুষের খোঁজে, পরবর্তীকালে দেওয়ানগাজীর কিসসা করেছি। ইবসেন করেছি, চেখভ করেছি। শেক্‌সপিয়ারের ম্যাকবেথ করেছি, টেম্পেস্ট করেছি। এমনকি আমি এমন বেয়াদবিও করেছি, শেক্‌সপিয়ারের হ্যামলেট রূপান্তর করেছি দর্পন নামে। ওই নাটকের অনুষ্ঠানপত্রে আমরা লিখেছিলাম, এ ঘটনা কি আমরা আমাদের দেশে দেখি না? সে নাটকে খালেদ খান অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন। তিনিই আমার হ্যামলেট।

প্রশ্ন: আপনাদের সবচেয়ে বড় অর্জন কী?

আলী যাকের: একটা দেশ, যার জন্ম হয়েছে ৪৭ বছর আগে, সত্যিকার স্বাধীনভাবে কাজ না করতে পারলে কখনোই সে দেশে বড় মাপের কাজ হয় না। ৪৭ বছর আগ থেকে আমরা কাজ আরম্ভ করেছি, কিছু মানুষ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন, যার দরুন আমরা স্বাধীনতা আন্দোলন করেছি, স্বাধীনতার পর আরও বড় মাপের কাজ করতে শুরু করেছি শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে। সেদিক থেকে বলব, আমরা আরও অনেক দূরে নিয়ে যেতে চাই নাট্যকর্মকে, নাট্যচিন্তাকে, নাট্যদর্শনকে। আমাদের মনকে আমরা জানতে চাইছি এবং সেই জানাটাকে আমরা সুচারুভাবে মঞ্চে সুঅভিনয়ের মাধ্যমে মানুষের সামনে তুলে ধরতে চাইছি। যদি থেকে থাকে, তবে এটাই আমাদের অর্জন। এই অর্জনটাই আমরা উদ্‌যাপন করছি। আমরা কেবল কতগুলো বছর উদ্‌যাপন করছি না।