গৌরবদীপ্ত নাম

দেওয়ান গাজীর কিস্‌সা
দেওয়ান গাজীর কিস্‌সা
>নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় তাদের দলের সুবর্ণজয়ন্তী ও দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাট্যচর্চার সাড়ে চার দশক পালন করছে ১৩ এপ্রিল থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। নাট৵দলটিকে নিয়ে আমাদের আজকের এই আয়োজন


নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে শুধু নয়; আমাদের সমগ্র শিল্পভুবনের এক অপ্রতিরোধ্য নাম। ‘নাগরিক’ আর মঞ্চ নাটক-এ দুই-ই ছিল দেশবাসীর কাছে সমার্থক এবং গৃহপ্রিয়ও বটে। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সন্ধ্যার আড্ডায় কেবল নাটকের কলাকুশলী ও কুশীলবের উপস্থিতি প্রাধান্য পেত না; প্রায় সব শিল্পমাধ্যমের সৃজনশীল মানুষ আসতেন অনাবিল আড্ডার মোহে। বাংলাদেশ ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। ‘নাগরিক’ মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ বক্ষে ধারণ করে নাট্যদলের অভিযাত্রা শুরু করে। নাগরিক-এর আড্ডার কথায় ফিরে এসে বলতে হয় যে দেশের অনেক কবি-সাহিত্যিক, চারুশিল্পী, স্থপতি, গায়ক-গায়িকা, নৃত্যশিল্পী নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সদস্যদের সঙ্গে ‘আড্ডার’ লোভ সামলাতে পারতেন না। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের বিভিন্ন নাট্য প্রযোজনায় দেশের অনেক কৃতী চারুশিল্পী, স্থপতিও বিভিন্ন নাটকের মঞ্চ পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। বেশ কয়েকজন নামী সংগীত ও নৃত্যশিল্পী নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের বিভিন্ন নাট্যের চাহিদা অনুযায়ী সংগীত ও কোরিওগ্রাফি পরিকল্পনা করে দিয়েছিলেন। স্যামুয়েল বেকেটের বিশ্বখ্যাত নাটক ওয়েটিং ফর গডোর জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরীকৃত অনুবাদ গডোর প্রতীক্ষায় নাটকের মঞ্চ পরিকল্পনার ধারণা দিয়েছিলেন দেশের কৃতী চারুশিল্পী মর্তুজা বশীর। নাগরিকের বিভিন্ন নাটকের পোস্টার ও স্মরণিকা ডিজাইন করে দিয়েছিলেন দেশের কীর্তিমান চারুশিল্পীরা, যাঁদের মধ্যে ছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। ১৯৭৩ সাল থেকে শুরু করে নাগরিক প্রায় ত্রিশ বছর মহিলা সমিতি ও গাইড হাউস মঞ্চে নিয়মিত নাটক মঞ্চায়ন করেছে। তখন রবিবার ছিল ছুটির দিন। এমন দিনও গেছে, সারা রাত মহড়া করে মহিলা সমিতি মঞ্চে বেলা ১১টায় নাটকের প্রদর্শনী করেছে নাগরিক। সে ছিল এক মহানন্দ ও বাঁধ ভাঙার দিন। নাগরিক বিশ্বাস করত, মঞ্চ থেকে কেবল সত্যই উচ্চারিত হয়, মঞ্চ নাটক প্রশাসকের রক্তচক্ষুকে ভয় করে না। মঞ্চ নাটক দুঃশাসন, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরোধিতা করে প্রত্যক্ষভাবে অথবা রূপকের মাধ্যমে। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় এভাবেই সবার অজ্ঞাতে একটি ‘ইনস্টিটিউশনে’ পরিণত হয়েছিল। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় দলের বিভিন্ন প্রযোজনায় দৃপ্ত ও বরাভয় বক্তব্যের জন্য প্রশাসনের রোষানলে পড়েছিল।
নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান কীর্তি হলো, দলটি দেশ-বিদেশের নাটককে সমভাবে আলিঙ্গন করেছে এবং আপতদুরূহ বেশ কিছু নাটক মঞ্চায়িত করে দর্শকনন্দিত হয়েছে। নাগরিক নাট্য প্রযোজনা দেশকে দেশের সীমানার বাইরে নিয়ে গেছে, আবার বিদেশকে নিয়ে এসেছে দেশে। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বাদল সরকার, মলিয়ের, আলবেয়ার ক্যামু, এডওয়ার্ড অ্যালবি, ফেরেঙ্ক মলনার, কার্ল স্যুখমায়ার, উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ার, স্যামুয়েল বেকেট, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বার্নাড শ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, বনফুল, এরিয়েল ডর্ফম্যান, বুদ্ধদেব বসু, উৎপল দত্ত, আন্তব চেখভ, বিজয় টেন্ডুলকার, সাইদ আহমেদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, নাসরিন জাহান, হুমায়ূন আহমেদ, রশিদ হায়দার প্রমুখ দেশ-বিদেশের নাট্যকারের নাটক মঞ্চায়িত করেছে। আমাদের দেশের কীর্তিমান নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হকের একাধিক নাটক নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় কৃতিত্বের সঙ্গে মঞ্চায়ন করেছে, যা দেশে-বিদেশে বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে। জার্মানির নাট্যকার বের্টল্ট ব্রেশটের রচিত চারটি নাটকের রূপান্তরিত অনূদিত রূপ নাগরিক সর্বাধিক সাফল্যের সঙ্গে বাংলাদেশে মঞ্চায়ন করেছে। ব্রেশটের নাটগুলোর মধ্যে দেওয়ান গাজীর কিস্‌সা সর্বাধিক অভিনীত ও জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহণ করে। নাটকটির রূপান্তর ও নির্দেশনায় ছিলেন দেশবরেণ্য অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর এবং প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন মঞ্চ নাটকের আরেক মহিরুহ আলী যাকের। 
নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় দেশের প্রথম নাটকের দল, যারা ভারত সরকারের (আইসিসিআর) আমন্ত্রণে আটের দশকে ভারতের দিল্লি, জয়পুর ও কলকাতায় সৈয়দ শামসুল হক রচিত নূরলদীনের সারাজীবন নাটকের বেশ কয়েকটি মঞ্চায়ন করে। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে ভারত, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, মিসর ও নেপালে দলের বিভিন্ন নাট্য প্রযোজনা কৃতিত্বের সঙ্গে মঞ্চায়ন করে। 
নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ছয়জন অভিনেতা তাঁদের নাট্যকৃতির জন্য জাতীয় গৌরবজনক ২১শে পদকে ভূষিত হয়েছিলেন। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের অন্যতম কীর্তিমান ও জনপ্রিয় অভিনেতা, নির্দেশক ও আবৃত্তিকার আসাদুজ্জামান নূর সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘স্বাধীনতা’ পদকে ভূষিত হন। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা হয় পরাধীন পাকিস্তানি শাসনকালে। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন কবি ও নাট্যকার জিয়া হায়দার এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বর্তমান লেখক। নাটকের দলটি পাকিস্তানি সময়ে টেলিভিশন ও রেডিওতে একাধিক নাটক পরিবেশন করেছে, কিন্তু নানাবিধ অসুবিধার কারণে মঞ্চে নাটক করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় বর্তমান লেখকের নির্দেশনায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের বিখ্যাত প্রহসন বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ-এর (বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ নাটকটির শিরোনামে মাইকেল এভাবেই লিখেছেন।) তিনটি প্রদর্শনী করে। এরপর ১৯৭৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি আলী যাকেরের নির্দেশনায় দেশে সর্বপ্রথম দর্শনীর বিনিময়ে বাদল সরকারের নাটক বাকি ইতিহাস মঞ্চায়িত হয় তদানীন্তন ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তনে। এর পরের ইতিহাস হলো, নাগরিকের দীর্ঘ পথ পরিক্রমা মহিলা সমিতি, গাইড হাউস ও শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে; যার সহযাত্রী ছিল দেশের প্রথম সারির সব নাট্যদল। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় আজ প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তি এবং দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাট্যচর্চার ৪৫ বছর পূর্তি উৎসব পালন করছে, যে গৌরবের অংশীদার দেশের সব মানুষ ও নাট্যকর্মীরা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এবং লক্ষ মানুষের জীবনের ও লক্ষ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ নামে যে ভূখণ্ডটি পৃথিবীর মানচিত্রে আপন মর্যাদার বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে; নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সব সদস্য এই আনন্দ উচ্ছ্বাসের লগ্নে, সেই ভূখণ্ড; জননী মাতৃভূমিকে প্রণতি জানাচ্ছে। জয় হোক মঞ্চ নাটকের।

আতাউর রহমান নাট্যব্যক্তিত্ব