খেটে খাওয়া মানুষের প্রিয় শিল্পী

ফরিদা পারভীন, জেমস, মমতাজ ও ইমরান
ফরিদা পারভীন, জেমস, মমতাজ ও ইমরান
>
মে দিবস সামনে রেখে আমরা কারওয়ান বাজার ও আশপাশ এলাকার ২৫ জন শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। জানতে চেয়েছি অবসরে তাঁরা কার গান শোনেন? প্রিয় শিল্পীর তালিকায় কে আছেন?


তেজগাঁও রেললাইনের পাশে লেগুনার গ্যারেজ। সেখান থেকে সিরিয়াল অনুযায়ী লেগুনা চলে যায় ফার্মগেটে হলিক্রসের সামনের স্ট্যান্ডে। সিরিয়াল পাওয়ার আগ পর্যন্ত এখানে বসে চালক ও সহকারীরা আড্ডা দেন। গত মঙ্গলবার দুপুরে গিয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। পরিচয় দিয়ে প্রিয় সংগীতশিল্পীর নাম জিজ্ঞেস করতেই খানিকটা সংশয়ে পড়েন তাঁরা। বিষয়টা পরিষ্কার করতেই এগিয়ে আসেন চালক কামরুল হাসান। নিজের মুঠোফোন বের করে দিয়ে বলেন, ‘আমার ফোনে ইমরান আর পড়শীর গান বেশি শুনতে পাবেন। ইমরানের “বলতে বলতে চলতে চলতে” গানটি অনেকবার শুনছি। পড়শীর সব গানই শুনি।’

লেগুনার সিরিয়াল নির্ধারণ করে দেওয়ার কাজে এতক্ষণ ব্যস্ত ছিলেন মনিরুজ্জামান। এগিয়ে এসে বললেন, ‘আমার পছন্দ মনির খান। তাঁর মাকে নিয়ে যতগুলো গান আছে, সবগুলো শুনি। নিজের মা বেঁচে নাই তো!’

চালকের সহকারী জামাল হোসেনের প্রিয় সংগীতশিল্পী বারী সিদ্দিকী। ইমরান আর মিলনের গান শোনেন আরেক সহকারী সাজন। নিজের মুঠোফোন বের করে মিলনের গানের ভিডিও দেখালেন তিনি। সাজনের খুব কাছের বন্ধু মোস্তাক। দুই বন্ধু মিলে একসঙ্গে ইমরানের গান শোনেন নিয়মিত।

জটলা দেখে নিজের লেগুনা জায়গায় রেখে এগিয়ে এলেন আল-আমিন। গানের আলাপ শুনেই কিছু একটা বলতে চাইলেন। কিন্তু সবার কথায় সুযোগ পেতে একটু সময় লাগল। ফাঁক পেয়ে বললেন, ‘ভাই, আমি সব সময় জেমসের গান শুনি। তাঁর “মা” গান আর বাংলাদেশ নিয়া গান দুইটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ।’ আল-আমিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই কয়েকজন চিৎকার করে উঠলেন। ‘হ্যাঁ জেমস, জেমস। গুরু ছাড়া কার গান শুনব।’ চিৎকার শুনে রাস্তা থেকে কয়েকজন তাকালেন।

ফার্মগেটের একটা ভবনে কাজ করছিলেন কয়েকজন রংমিস্ত্রি। মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা। হালিম নামের একজনের কাছে জানতে চাইতেই বললেন, ‘গান কম শুনি, তবে যখন শুনি তখন মনির খানের গানই বেশি শোনা হয়।’ তাঁর সঙ্গে গলা মেলালেন আরও দুজন। ‘অঞ্জনাকে নিয়ে গাওয়া গানগুলো আমার খুব পছন্দ।’ বললেন তাঁর সহকর্মী রায়হান।

গত সোমবার গুলশান এক নম্বরে একটি রাস্তার সংস্কারকাজ করছিলেন চান মিয়া। পকেটে বাজছিল মুঠোফোন। সেখান থেকে ভেসে আসছিল ফরিদা পারভীনের কণ্ঠ। জানতে চাইলে বললেন, ‘অমন কইরা মাটির গান আর কে গাইতে পারে, কন? অনেক আগে থাইকাই তাঁর ভক্ত আমি।’ সঙ্গী আরও দুজন গলা মেলালেন চান মিয়ার সঙ্গে।

তবে কারওয়ান বাজারের ওরবরই বিক্রেতা রাসেল জানালেন, তাঁর পছন্দের শিল্পী মমতাজ। মমতাজের গাওয়া গান মিস করেন না তিনি।

ভক্তদের নিয়ে দারুণ উচ্ছ্বসিত ফরিদা পারভীন। বললেন, ‘তাঁদের কারণেই তো আমি শিল্পী। কয়েক বছর আগে মে দিবসে ট্রাকচালকদের একটা অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়েছিলাম। তাঁদের ভালোবাসার মধ্যে একটা সততা আমি পেয়েছিলাম, যেটা অনেকের মধ্যেই আজকাল দেখি না।’

এমন ভক্তদের কথা শুনে সংগীতশিল্পী মনির খান বললেন, ‘আমরা তো সবাই শ্রমিক। আমি নিজেও তো কণ্ঠশ্রমিক। আমি গান করেছি—“আমি মনির খান, গাই তোমাদের গান, শ্রমিকের একই পরিচয়, অভাবকে করবই জয়।” এ কারণে শ্রমিকদের সঙ্গে আমার একটা নিবিড় সম্পর্ক। আমি আসলে বাণীপ্রধান গান করতে পছন্দ করি। বিশেষ করে, সমাজের খেটে খাওয়া এবং অবহেলিত মানুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্য কিছু গান আছে। সুর দিয়ে ওঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি। এ কারণে তাঁরা সম্ভবত আমাকে খুব পছন্দ করেন।’

ভক্তদের নিয়ে কথা হলো সংগীতশিল্পী ইমরানের সঙ্গে। বললেন, ‘এমন ভক্তদের আমি খুবই সম্মান করি। তাঁদের সেবা আমাদের সবার জন্যই খুব জরুরি। মন থেকে তাঁদের খুব ভালোবাসি। তাঁরা যেন ভালো থাকেন, সুস্থ থাকেন, এই দোয়া করি।’