কানে চোখ

>

শুরু হয়ে গেছে কান চলচ্চিত্র উৎসব। প্রথম আলোর প্রতিনিধি আদর রহমান উপস্থিত আছেন সেখানে । ৭১তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের আগ্রহের শীর্ষে থাকা কিছু বিষয় নিয়ে কান থেকে তিনি লিখেছেন এই ফিচার

কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব
কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব

একটা আস্ত শহর কেমন করে শুধু সিনেমার ওপর ভর করে বেঁচে আছে? এটা কানে না গেলে বোঝা যাবে না। শহরটার রূপ-রং-ঢং পুরো পাল্টে যায় মে মাস এলে। শুরু হয় কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মৌসুম। সাগরপারের ছোট্ট শহরটি জমজমাট হয়ে ওঠে সিনে বণিকদের আনাগোনায়। যেহেতু আমরা এখন মে মাসে দাঁড়িয়ে, তাই বলার অপেক্ষা রাখে। ৮ মে শুরু হওয়া এ উৎসব চলবে ১৯ মে পর্যন্ত। বছরের সেরা নির্মাতাদের সেরা সিনেমাগুলো একেকটা অ্যাটম বোমার মতো বিস্ফোরণের অপেক্ষায় আছে। কানে একদিকে ছবিগুলোর উদ্বোধনী প্রদর্শনী হবে, অন্যদিকে মুহূর্তেই বিশ্বজোড়া সিনেমাপ্রেমীদের কাছে সেগুলো হয়ে উঠবে আড্ডা-বাহাস-আলোচনার মূল বিষয়বস্তু।

দ্য হাউজ দ্যাট জ্যাক বিল্ট ছবির দৃশ্য
দ্য হাউজ দ্যাট জ্যাক বিল্ট ছবির দৃশ্য

২১-এর যুদ্ধ

৭১তম কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সবচেয়ে সম্মানজনক স্বীকৃতি পাম দ’র জন্য লড়বে ২টি ছবি। তিন দফায় এবার ঘোষণা করা হয়েছে প্রতিযোগিতা বিভাগের ২১টি ছবির নাম। উদ্বোধনী ছবি হিসেবে আসগর ফরহাদির এভরিবডি নোজ–এর নাম ঘোষণার মধ্য দিয়ে চমক দেওয়া শুরু হয়। এরপর প্রকাশ করা হয় প্রতিযোগিতা বিভাগের ১৭টি ছবির নাম। সবশেষ তালিকায় আরও তিনটি ছবির নাম যোগ করে সব কৌতূহলে এবারের মতো ইতি টানা হয়।

লার্স ফন ট্রিয়ারের ফিরে আসা

নিজেকে হিটলারের অনুসারী ও মনেপ্রাণে একজন নাৎসি বলে মেনেছিলেন নির্মাতা লার্স ফন ট্রিয়ার। ২০১১ সালে কান উৎসবে নিজের ছবি মেলানকোলিয়ার সংবাদ সম্মেলনে এভাবেই নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে রীতিমতো ফেঁসে গিয়েছিলেন ট্রিয়া। উৎসব থেকে নিষিদ্ধ হতে হয়েছিল তাঁকে। অল্প সময়ের ব্যবধানে গ্রাঁ প্রি, প্রি দ্যু জুর, টেকনিক্যাল গ্র্যান্ড প্রাইজ ও সবচেয়ে বড় পাম দ’র জেতার পরও তাঁর গায়ে লেগেছিল ‘ব্যান’–এর তকমা। তবে এবার দুর্ভাগ্য কেটেছে। দীর্ঘ সময় পর প্রতিযোগিতার বাইরে হলেও কানের অফিশিয়াল সিলেকশনে এসেছে লার্স ফন ট্রিয়ার নতুন ছবি, নাম দ্য হাউজ দ্যাট জ্যাক বিল্ট

জাঁ লুক গদার
জাঁ লুক গদার

গদার সবখানে

সিনেমাবোদ্ধা দর্শকদের ব্যক্তিত্বের ভার বোঝাতে অনেক সময়ই আমরা ঠাট্টা করে বলে থাকি, ‘সে তো গদারের ছবি ছাড়া দেখেই না!’ এটা দিয়ে আমরা কিন্তু সেই দর্শকের সিনেমা-স্বাদের উচ্চমান প্রকাশ করি। কারণ, ফরাসি নির্মাতা জাঁ–লুক গদার একজন নির্মাতাই নন শুধু, এখন দর্শকরুচির মাপকাঠি পরিমাপের একটা উপকরণ বলা চলে। ৮৭ বছর বয়সী সুইডিশ সেই নির্মাতা এবার উৎসবের আদ্যোপান্তে লেপ্টে আছেন। তাঁর নতুন ছবি এবার আবারও লড়বে পাম দ’র জন্য, অন্যদিকে তাঁর সাড়া জাগানো সিনেমা পিয়েরো ল ফুর একটি চুম্বন দৃশ্য এবারের উৎসবের পোস্টারের প্রাণ। এখন কানের যেদিকেই চোখ যায়, সেদিকেই শুধু গদারের সৃষ্ট দুই চরিত্র ‘পিয়েরো’ ও ‘মারিয়েন’–এর (জ্যঁ পল বেলমন্ড ও অ্যানা কারিনা) প্রেমময় চুম্বনের ছড়াছড়ি। মোটকথা, ফরাসি সিনেমার নব–বিপ্লবের এই কান্ডারি এই বয়সে এসেও অতীত-বর্তমান মিলিয়ে এ বছরের উৎসবে আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

সোলো:  আ স্টার ওয়ার্স স্টোরি ছবির পোস্টার
সোলো: আ স্টার ওয়ার্স স্টোরি ছবির পোস্টার

কানে আবার হান সোলো

১৩ বছর পর কানে ফিরছে হান সোলো: স্টার ওয়ার্স ফ্রাঞ্চাইজির সেই কান্ডারি, যাকে দেখে ছোট থেকে বড় ও বড় থেকে বুড়ো হতে চলেছে একটি প্রজন্ম। প্রতিযোগিতা বিভাগের বাইরের ছবি এটি। তবু এটি নিয়ে উত্তেজনার কমতি নেই। ২০০২ সালে স্টার ওয়ার্স: এপিসোড টু: অ্যাটাক অব দ্য ক্লোনস ও ২০০৫ সালে স্টার ওয়ার্স: এপিসোড থ্রি: রিভেঞ্জ অব দ্য সিথ-এর পর এবার উৎসবে জায়গা পেল সোলো: আ স্টার ওয়ার্স স্টোরি

যা কিছু নতুন

এবার কানের লালগালিচায় তারকা-অতারকা (!) কেউই সেলফি তুলতে পারবেন না। সেলফি নামের এই উটকো ঝামেলা অনেক সময় নষ্ট করে উৎসব কর্তৃপক্ষের। তাই এবারের নতুন নিয়ম—কানের লালগালিচায় সেলফি তোলা নিষিদ্ধ। নতুন নিয়ম আরও আছে। সিনেমাপ্রমীদের জীবনের বিষফোড়া ‘স্পয়লার’ ঠেকাতে এ বছর থেকে এক কড়া নিয়ম চালু করেছে উৎসব আয়োজকেরা। এবার থেকে মূল লালগালিচা উদ্বোধনী প্রদর্শনীর আগে কেউ উৎসবের সিনেমাটি আগেভাগে দেখতে পাবেন না। এত বছর মূল প্রদর্শনীর আগে সাংবাদিক, চলচ্চিত্র সমালোচক ও বোদ্ধাদের জন্য ছবির অগ্রিম প্রদর্শনী রাখা হতো, যেন পত্রিকা বা ব্লগের জন্য দিন দিন ছবির রিভিউ লিখে তা সময়মতো প্রকাশ করা যায়। কিন্তু টুইট আর স্ট্যাটাসের এই যুগে কিছু অবিবেচক চিত্রসমালোচক ও বোদ্ধা নাকি ছবির মূল আকর্ষণ এর মূল প্রদর্শনীর আগেই ফাঁস করে দিতেন। উৎসব কর্তৃপক্ষের ধারণা, এর ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ত লালগালিচা প্রদর্শনীতে। ছবি শুরুর আগেই এর শেষের চমক নিয়ে শুরু হয়ে যেত হট্টগোল। তাই এবার থেকে ‘স্পয়লার’ আর না। অনেক সমালোচনা-বিতর্কের পরেও উৎসব কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ছবির একাধিক প্রদর্শনী করা হবে, তবে তা মূল আয়োজনের পর।

নতুন নিয়মের পাশাপাশি নতুন কিছু উদ্যোগও এবারের উৎসবে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত উদ্যোগটি হলো—যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ‘হেলপলাইন’। বিশ্ব তোলপাড় করা হার্ভি ওয়াইনস্টিন যৌন হয়রানি কাণ্ড এবারের কান উৎসব কর্তৃপক্ষকেও ভাবিয়েছে। দ্য নিউইয়র্কারনিউইয়র্ক টাইমস-এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের একটিতে অভিনেত্রী এশিয়া আর্জেন্টো বলেছিলেন, এই কান চলচ্চিত্র উৎসবে এসেই তিনি হার্ভি দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। তাই এবার তা থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছে উৎসব আয়োজকেরা। আয়োজক ও ফরাসি সরকার মিলে একটি বিশেষ সহায়তা ব্যবস্থা চালু করেছে, যেখানে হয়রানির শিকার যে কেউ কিংবা যেকোনো প্রত্যক্ষদর্শী ফোন করে সাহায্য চাইতে পারেন। তাঁদের ডাকের সাড়া দ্রুত দেওয়া হবে।