'মাসুদ রানা' ও 'কুয়াশা' নিয়ে ছবি হয়েছিল

সোহেল রানা অভিনয় করেছিলেন ‘মাসুদ রানা’ চরিত্রে আর রহস্য পুরুষ ‘কুয়াশা’ আনোয়ার হোসেন
সোহেল রানা অভিনয় করেছিলেন ‘মাসুদ রানা’ চরিত্রে আর রহস্য পুরুষ ‘কুয়াশা’ আনোয়ার হোসেন

বাংলাদেশের জনপ্রিয় গোয়েন্দা ছিল মাসুদ রানা। ১৯৮০-১৯৯০ দশকে। গোয়েন্দারা সাধারণত জনপ্রিয় হয় না। মানুষ এড়িয়ে চলে। কিন্তু ‘মাসুদ রানা’কে সবাই কাছে পেতে চায়। সে দেশপ্রেমিক। সে হ্যান্ডসাম। সে রোমান্টিক। সে ভয়ংকর! ক্রিমিনালের পেছনে জীবন বাজি রেখে ছুটে বেড়ায় ঢাকা থেকে ওয়াশিংটন-লন্ডন-ভেনিস-প্যারিস। আর এই সবকিছুরই হোতা তার বাবা কাজী আনোয়ার হোসেন, কাজী মোতাহার হোসেনের ছেলে। বাংলাদেশের এক জীবন্ত কিংবদন্তি লেখক। এ দেশের সাহিত্যের রাস্তায় তুলে দিয়েছিলেন এক নতুন ফ্লাইওভার। হয়েছিলেন নন্দিত, হয়েছিলেন নিন্দিতও! বই ছাপা হয় সাদা কাগজে, তিনি ছাপেন নিউজপ্রিন্টে। কম দামে ছেলেমেয়েদের পড়ার অভ্যাস গড়বেন। গড়েছিলেনও। ছেলেমেয়েদের হাতে হাতে ‘মাসুদ রানা’। মাদকাসক্তের মতো ছেলেমেয়েরা মাসুদাসক্ত। নিন্দায় ফুঁসে ওঠেন দেশের বেশির ভাগ সাহিত্যিক। ছেলেমেয়েদের নষ্ট করছেন কাজী। মাসুদ রানায় অ্যাডাল্ট কনটেন্ট আছে। দমলেন না এই গোয়েন্দার বাবা। কিশোরদের জন্য পাশাপাশি আরেকটি মজার গোয়েন্দা সিরিজ লিখলেন, ‘কুয়াশা’। কুয়াশা সৎ, পরোপকারী, ভয়ংকর পলাতক আসামি। কিন্তু অবসরে সেতার বাজায়। খুব ভালো হাত তার। অ্যাডাল্ট কনটেন্ট নেই। নে, এবার গালি দে!

স্কুলের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে নিয়মিত ‘কুয়াশা’ কিনি। স্কুলের পড়ার ফাঁকে বাসার ছাদের ওপরের সানশেডে লুকিয়ে ‘কুয়াশা’ পড়ি। নিউমার্কেটের দক্ষিণ গেটের বইয়ের দোকানি দেখা হলেই বলে, পরশু আইব বা তরশু আইসেন। জানে, ‘কুয়াশা’ আসামাত্রই নাই হয়ে যাবে।

‘মাসুদ রানা’ ও ‘কুয়াশা’—দুটোর কাহিনি নিয়েই মুভি হয়েছিল। সোহেল রানা অভিনয় করেছিলেন ‘মাসুদ রানা’ আর রহস্যপুরুষ ‘কুয়াশা’ ছবিতে শক্তিমান অভিনেতা ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ আনোয়ার হোসেন। লম্বা কালো ওভারকোট আর কালো ফেল্ট হ্যাটে তাঁকে মানিয়েছিল দারুণ! দুটো ছবিই সুপার হিট হয়েছিল। এখন বানালে আবারও বক্স অফিস হিট হবে।

শুধু গোয়েন্দা সিরিজ না, বাংলাদেশের কিশোর-তরুণদের হাতে আলেকজান্ডার দ্যুমা, রবার্ট লুই স্টিভেনসন, মার্ক টোয়েন, জ্যাক লন্ডনসহ বিশ্বের নামীদামি লেখকের ক্ল্যাসিক বইগুলো সহজ সরল ভাষায় তুলে দিয়েছিলেন এই ‘সকল কাজের কাজী’। শুধু সাধারণ ছেলেমেয়েরাই না, অস্ত্রধারী মাস্তানদের হাতেও তার বই দেখা যেত। তার প্রকাশিত বই দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে কলকাতায় বিশাল মার্কেট করে নেয়!

শুনে রাখেন, আশির দশকে তরুণ হুমায়ূন আহমেদের বই প্রকাশ করে দিয়েছিলেন এই ‘সো কল্ড নিন্দিত’ লেখক তাঁর সেবা প্রকাশনী থেকেই। হ্যান্ডসাম টাকাও দিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদকে। টাকাটা হুমায়ূন আহমেদের খুব দরকার ছিল সেই সময়ে। তখন তিনি কিংবদন্তি হননি। আরও শুনে রাখেন, দেশের লিজেন্ড প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব এষ তারুণ্যে ছিলেন এই সেবা প্রকাশনীরই অফিশিয়াল অলংকরণ শিল্পী। সেবা প্রকাশনীর বেশির ভাগ বইয়ের প্রচ্ছদ তাঁরই করা। সেবা মানে কিন্তু শুধু সেবা করা না। সেগুনবাগিচার সংক্ষিপ্ত রূপ ‘সেবা’। হ্যাঁ, সেগুনবাগিচায় মাসুদ রানার বাবার বাড়িতেই এই অফিস।

গত শতকে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল প্রকাশিত মাসিক ম্যাগাজিন ছিল আমেরিকার ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’। বিভিন্ন দেশের ভাষায় তা বের হতো। বাঙালি বাদ থাকবে কেন? কাজী আনোয়ার হোসেন বের করলেন মাসিক ‘রহস্য পত্রিকা’। ‘রহস্য পত্রিকা’য় ডিটেকটিভ গল্প, ছোট গল্প, বড় গল্প, মজার তথ্য সবই থাকে। আর থাকে রম্য রচনা। এবার মজার কথায় আসি।

রহস্য পত্রিকার রম্য গল্প আমার মোটেই ভালো লাগছে না। অথচ একজন নামকরা লেখক নিয়মিত তা লিখছেন। ভাবলাম, এগুলো যদি হাসির গল্প হয়, তাহলে আমি এর চেয়ে ভালো লিখব। লিখলাম জীবনের প্রথম গল্প। নিউমার্কেট পোস্ট অফিস থেকে রেজিস্ট্রি ডাকে সেটা পাঠালাম। টাশকি খেলাম পরের মাসে! ঝকঝকে রঙিন অক্ষরে প্রচ্ছদেই আমার গল্পের নাম! নীলক্ষেতের এক দোকান থেকে ঝুলন্ত বইটা কিনে বাসার দিকে দিলাম ছুট, যেন প্লেন টেক অফ করবে রানওয়ে থেকে। উৎসাহে লিখে ফেললাম দ্বিতীয় গল্প। পাঠালাম। ছাপলো। ‘আমি প্লেন’ এবার আকাশে উঠে গেলাম। একের পর এক হাসির গল্প লিখি, পাঠাই আর ছাপানো হয়। চিঠিপত্র পাতায় দেখি আমার গল্পের প্রশংসা করেছে ধানমন্ডির এক মেয়ে। এবার ‘আমি প্লেন’ মেঘের ওপরে উঠে গেলাম! ফোন করলাম সেবা অফিসে। একজন ধরে বললেন, ‘আরে, আপনাকে তো সম্পাদক সাহেব খুঁজতেসেন। কাল সন্ধ্যায় আসেন অফিসে। বসের সঙ্গে দেখা করবেন!’ ধক করে উঠে বুক। যে প্রবাদপুরুষের লেখা পড়ে কল্পনার জগতে ভেসেছি, সারা বাংলাদেশে যার কোটি ভক্ত! তিনি ডেকেছেন আমাকে?

পরের সন্ধ্যায় অফিসে যেতেই থামালেন অ্যাকাউন্ট্যান্ট সাহেব। বললেন, ‘আপনি তো আমার হিসাব নিকাশে গন্ডগোল লাগায় দিসেন। সই করেন এইখানে।’ সই করলাম। হাতে ধরিয়ে দিলেন প্রায় তিন হাজার টাকা। কুল ডাউন। তখন ১টা কোকের দাম ৫ টাকা, ধানমন্ডি থেকে গুলশান স্কুটার ভাড়া ২০ টাকা, আর আমি সবে ভার্সিটিতে ঢোকা পকেট ফাঁকা ছাত্র। লিখে এত টাকা পাওয়া যায়?

ফোনে কথা বলে ম্যানেজার বললেন, ‘দোতলায় যান। বস বসে আছেন।’

একা দোতলায় উঠছি, বুক কাঁপছে। শুনেছি, ওনার একটা লাইসেন্স করা পিস্তলও আছে। মনে হচ্ছে গোয়েন্দা মাসুদ রানার বাবার অফিসে না, গোয়েন্দা অফিসেই যাচ্ছি। রিমান্ডে।

অফিস রুমটা সাউন্ডপ্রুফ লাগল। চারদিকে শুধু বুঁদ বুঁদের শব্দ। তিন দেয়ালেই অ্যাকুরিয়াম। রং-বেরঙের মাছ। শব্দ সেখান থেকেই আসছে। টেবিলে যত্নে কাপড়ে ঢাকা কিছু একটা দেখলাম। মনে হলো, ওটাই ওনার সেই পিস্তল। মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘বোসো।’ আন্তরিক কথা হলো। কোক-পেস্ট্রি এল। কাপড়ে ঢাকা বস্তুটাকে আস্তে ও সন্তর্পণে নিজের কাছে টেনে নিলেন। সতর্ক হয়ে উঠলাম। বললেন, ‘তুমি এখন থেকে আমার পত্রিকায় রেগুলার হাসির গল্প লিখবে।’ এবার ‘আমি প্লেন’ মেঘের মধ্যে বাম্পিং শুরু করলাম। কারণ, সামনে কিছু দেখা যাচ্ছে না খুশিতে।

রম্য গল্পগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠল। আমার বই বের করে দিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। একাধিক বইয়ের জন্য উনি আমাকে এক যুগেরও বেশি রেগুলার রয়ালটি দিয়েছেন। একবার কথায় কথায় সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বললেন, ‘আমরা খুবই ভালো বন্ধু। ছোটকালে খুব দুষ্টু ছিলাম। দুজনই পেছনের বেঞ্চে বসতাম। কিন্তু মুশকিল হলো, আজ পর্যন্ত সে আমার কোনো বই পড়েনি, আমিও তার কোনো বই পড়ে দেখিনি।’ সাংবাদিকেরা একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘সব সময় সঙ্গে পিস্তল রাখেন কেন?’ উত্তরে বলেছিলেন, ‘অন্তত অসহায়ের মতো মরতে চাই না।’

প্রায় দুই দশক নিভৃত জীবন যাপন করছেন এই কিংবদন্তি। আমরা শিল্প-সাহিত্য-বিনোদন জগতের কিংবদন্তিদের জীবদ্দশায় কতটুকু খোঁজ নেই? কতটুকু প্রাপ্য সম্মান তাঁরা পান? এই তো সেদিন চলে গেলেন সুরের লিজেন্ড লাকী আখান্দ ভাই, বারী সিদ্দিকি। চলে গেলেন কাছের মানুষ অভিনেত্রী দিতি আপা। চলে গেলেন কিংবদন্তি হুমায়ূন আহমেদ। এ দেশে বইয়ের অগুনতি পাঠক তৈরিতে যে দু'জন লেখকের বিশাল অবদান, তারা হলেন কাজী আনোয়ার হোসেন ও হুমায়ূন আহমেদ। দেশের জীবন্ত কিংবদন্তিদের সম্মান দেখাতে টাকা লাগে না, সৎ উদ্যোগ লাগে। আর তা দেখানোর সময় এসেছে। আমরা যেন প্রবাদটা আমাদের জন্য সত্যে পরিণত না করি—যে দেশ গুণীর কদর করে না, সে দেশে গুণী জন্ম নেয় না।