শ্রোতারা কেউ বোকা না

সাহানা বাজপেয়ি ছবি: খালেদ সরকার
সাহানা বাজপেয়ি ছবি: খালেদ সরকার
>জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সাহানা বাজপেয়ি। লোকসংগীতও তাঁর গলায় দারুণ মানিয়ে যায়। শান্তিনিকেতনে বেড়ে ওঠা এই শিল্পী টানা আট বছর থেকেছেন বাংলাদেশে। এবার এ দেশে এসেছিলেন ১০ বছর পর। ব্যস্ততার মধ্যে সময় দিয়েছেন প্রথম আলোকে। বিস্তারিত লিখেছেন মেহেদী মাসুদ

‘ঠিক ১০ বছর পর এসেছি। যেদিন ঢাকা ছেড়ে গেছি, সেদিন ছিল ২০০৮ সালের ৪ মে। এবার ঢাকায় এসেছি সেই ৪ মে তারিখে।’ বললেন সাহানা বাজপেয়ি। কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে তাঁর। চোখ ভিজে যায়। কিন্তু মুখে সেই চেনা হাসি। মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেন। বলেন, ‘ঢাকার মাটিতে যখন পা রেখেছি, নাকে এসে লেগেছে এই শহরের গন্ধ। আমার চোখ ভিজে যায়। এই কান্না ছিল আনন্দের। সব মিলিয়ে অন্য রকম এক অনুভূতি।’

সেই তো ঢাকায় এলেন, এত দিন পরে কেন? ‘অভিমান।’ বললেন তিনি, ‘এত ভালোবাসা এই শহরটার সঙ্গে। ১০ বছর পরে আসব, এভাবে ভাবিনি। আমন্ত্রণ অনেক পেয়েছি। নানা অছিলায় আসা হয়নি। নিজেকে সময় দিয়েছি। একদিন ভেবেছিলাম, সারা জীবন এই শহরে কাটবে। হয়নি। কোথাও একটা অভিমান কাজ করত। যখন বুঝেছি, এবার সময় হয়েছে। অভিমান সব গলে গেছে। চলে এলাম।’ এবার তিনি গানবাংলা টিভিতে ‘উইন্ড অব চেঞ্জ’ অনুষ্ঠানে গান করলেন। ১১ মে পর্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন রেকর্ডিং নিয়ে। এর মধ্যে একটি অনুষ্ঠানেও গান গেয়েছেন তিনি।

৭ মে সোমবার দুপুর। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবনের ছাদে বসে কথা হচ্ছিল সাহানা বাজপেয়ির সঙ্গে। সোমবার ‘প্রথম আলো আলাপন’ আয়োজনে আমন্ত্রণ জানানো হয় তাঁকে। এর মধ্যেই আড্ডা। আড্ডা তাঁর খুব প্রিয়। ঢাকায় এসেই ছুটে গেছেন সেই পুরোনো বন্ধুদের কাছে। আবার সেই আড্ডা, মজার মজার খাবার খাওয়া আর গানবাজনা। বললেন, ‘এই শহরের গন্ধটা সেই আগের মতোই আছে। রাস্তাঘাট সবকিছু ছবির মতো মনে আছে। একটু বদলেছে, যানজট তখন এতটা ছিল না। নতুন অনেক বাড়ি হয়েছে। তবে মানুষগুলো সেই আগের মতোই আছেন। আগের মতোই আদর করেন।’

১০ বছর আগে চলে যাওয়া খুব জরুরি ছিল? মুহূর্তেই চুপ হয়ে যান সাহানা বাজপেয়ি। তাকিয়ে থাকেন অনেক দূরে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, ‘আমার মনে হয় জরুরি ছিল। এই শহরে এসেছিলাম বিয়ে করে। আমাদের বিয়েটা কলকাতায় হয়েছিল। কিন্তু একসময় মনে হলো, সেই সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা কোথাও ফুরিয়ে গিয়েছে। চলে যেতে হয় আমাকে।’

সুরকার, সংগীত পরিচালক আর সংগীতশিল্পী অর্ণবের সঙ্গে সাহানা বাজপেয়ির সেই ছোটবেলার বন্ধুত্ব। প্রেমটাও ছোটবেলা থেকেই। হাসতে হাসতে সাহানা বাজপেয়ি বললেন, ‘আমাদের বিয়ে যখন হয়েছিল, তখন আমার বয়স ছিল ২১ বছর। সেটাও ছোটবেলা।’ একসময় বিচ্ছেদ ঘটে তাঁদের। তখন ঢাকায় আট বছর ছিলেন সাহানা বাজপেয়ি।

পুরোনো স্মৃতি থেকে বললেন, ‘ভুলতে পারি না বন্ধুদের সঙ্গে গান গাওয়া। একসঙ্গে বসে আড্ডা। নতুন গান বানানো। নতুনভাবে গান করা। তখন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে পড়াতাম। সেই সময়গুলো আমার কাছে খুব আদরের। আমার ছাত্রছাত্রীরা, সহকর্মীরা।’

একসময় সাহানা বাজপেয়ির কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনে নতুন প্রজন্ম চমকে গিয়েছিল, ‘আমার নিশীথ রাতের বাদল ধারা’। এভাবে রবীন্দ্রসংগীত উপস্থাপন করা যায়? এবার সাহানা বাজপেয়ি খুব প্রাণবন্ত। বললেন, ‘নব্বইয়ের দশক, আমাদের বয়সী যারা, তাদের অনেকেই রবীন্দ্রসংগীত শুনত না। আমরা গাইতাম, টিপ্পনী শুনতাম-ঘুমপাড়ানি গান, একঘেয়ে গান। সেখান থেকে ভেবেছিলাম, একটু যদি যন্ত্রানুষঙ্গে অন্য রকম ধারা আনা যায়। একটা গিটার দিয়ে গান গাওয়া, একটু হারমনি কোথাও কোথাও। স্বরলিপি অবিকৃত থাকছে। আমরা তো নষ্ট করার জন্য কিছু করছি না। যা করছি, ভালোবেসেই করছি। রবীন্দ্রনাথের গান যদি হারিয়ে যায়, তাহলে বাঙালির বাঙালিত্ব অনেকটাই চলে যাবে। এই ধারণা থেকে করা।’ এই কাজ করতে এসে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে তাঁকে। বললেন, ‘সমালোচনা তো হবেই। সবার তো সব ভালো লাগে না। শিল্পের ক্ষেত্রে পুরোটাই আপেক্ষিক।’

যখন সাহানা বাজপেয়িকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তখন বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে বলার আমি কেউ না।’ তবে আড্ডায় বসে বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে গিয়ে গানগুলো বানিয়েছিলেন। তখন যা হচ্ছিল, তা থেকে বেরিয়ে নতুন এক ধারা তৈরি করেছিলেন। ফলে তাঁকে আবার বেঁধে ফেলা ঠিক না। তিনি তো বলেছেন, হারমোনিয়াম যেন আমার গানের সঙ্গে না বাজে। খালি গলায় গান বেশি পছন্দ করতেন। এখন হারমোনিয়াম ছাড়া রবীন্দ্রনাথের গান ভাবাই যায় না!’ গান গাওয়ার স্বাধীনতা নিয়ে বললেন, ‘শিল্পী হিসেবে মনে হয়, স্বাধীনতা অনেক বড় একটা জায়গা। আর শ্রোতারা কেউ বোকা নন। তাঁদের যেটা ভালো লাগবে, তাঁরা সেটা শুনবেন। যেটা লাগবে না, সেটা শুনবেন না।’

অনেকের কাছেই সাহানা বাজপেয়ি রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী। কিন্তু যাঁরা তাঁর কণ্ঠে লোকগান শুনেছেন, তাঁদের মন্তব্য, বাহ্! বললেন, ‘ফোক ছোটবেলা থেকেই গাই। বীরভূমে অনেক বাউল আছেন। আমি শান্তিনিকেতনের মেয়ে। আমাদের পাড়ার বাউল বাসুদাকে ছোটবেলা থেকে দেখেছি। তখন থেকে লোকগানের প্রতি আগ্রহ। বাংলাদেশে আসার পর অনেক গান শুনেছি। বাউল গানে একধরনের স্বাধীনতা আছে। গেল গেল রব নেই। সা যদি পা হয়ে যায়, ভয় লাগে না। স্বরলিপিতে বাধা নেই। গলা ছেড়ে গাওয়ার ব্যাপার আছে। নিজেকে খুলে দেওয়া যায়।’

অর্ণব গানের ছেলে। আপনার কাছে? সাহানা বাজপেয়ি বললেন, ‘আপনারা যেভাবে ওকে চেনেন, সেভাবেই দেখবেন। কেউ যদি প্রশ্ন করে, দুই বাংলা মিলিয়ে আমার প্রিয় শিল্পী কে, বলব শায়ান চৌধুরী অর্ণব। ও আমাদের সময়ের। খুব মেধাবী। ও ওর নিজের সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। ওর সেই শিল্পীসত্তাকেই সবার মাথায় রাখা উচিত।’

জানালেন, তিনি এখন লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে স্কুল অব ওরিয়েন্টাল আফ্রিকান স্টাডিজ নামে একটা কলেজে আছেন। সেখানে পৃথিবীর প্রায় সব ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা হয়। সেখানে সাহানা বাজপেয়ি বাংলা ভাষা, সাহিত্য আর সংস্কৃতি পড়ান। সাহানা বাজপেয়ি লন্ডনে আবার বিয়ে করেছেন। তাঁর স্বামী রিচার্ড হ্যারেট। তাঁদের মেয়ে রোহিনীর বয়স পাঁচ।