ডিয়ার গানপাগল

গানপাগল দলের সদস্যরা
গানপাগল দলের সদস্যরা

গানের বাণী আর সুরের ব্যাকরণ নিয়ে কে তাঁদের ভাবতে বলেছে? এখন কি সেই সময়? প্রতিষ্ঠা পেতে হবে। সে জন্য চাই প্রচুর প্রচার, প্রচুর শো। টিভি, রেডিও, মঞ্চ, শহর, গ্রাম, গঞ্জ—কোথাও বাদ যাবে না। গাইতে হবে। থাকতে হবে পোস্টার, বিলবোর্ড ও বিজ্ঞাপনে। জাগতিক জীবন চুলোয় যাবে, যাক।

গানপাগল এসবে নেই। নেই বলেই হয়তো খুব একটা দেখা যায় না তাঁদের। অথচ তাঁদের কিছু গান আছে। তাৎক্ষণিক রোমাঞ্চিত করবে না সেগুলো, ছড়াবে না উত্তেজনা। তবে গানগুলো শ্রোতাদের থমকে দেবে কিছুক্ষণের জন্য। চেতনায় এঁকে দেবে চিন্তনের দাগ। সে রকম কয়েকটি গান ‘আমার বেলকনিতে’, ‘প্রজাপতি আমার মন’ কিংবা ‘খুঁজি তোরে কাছে দূরে’। এগুলো ছাড়াও ‘বাঘবন্দী মন বন্দী’ ও ‘সাধন ভজন চায় যদি মন’ গান দুটি বিশেষভাবে পছন্দ করেছেন এপার বাংলা ও ওপার বাংলার শ্রোতারা। বিভিন্ন সময়ে টিভি ও মঞ্চে করা এ গানগুলো সার্চ দিলেই মিলবে ইউটিউবে।
শুরুতে অন্য দলে গাইতেন গানপাগলের কণ্ঠশিল্পী শোয়েব। অন্য এক দলে বাজাতেন বেহালাশিল্পী শিউলি। গানপাগলের বাদবাকি বন্ধুরা বাজাতেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, আজ এখানে কাল ওখানে। অথচ একসঙ্গেই তাঁদের ওঠা-বসা, গান-বাদ্য করা। একদিন কাছের বন্ধুরাই প্রস্তাব করলেন, চলো একত্র হই। সেই তাগিদে দুই বছর ধরে চলল অনুশীলন। অনুশীলনের ক্ষণ-কাল নির্ধারণী গ্রুপ মেসেজে তখন থেকেই লেখা হতো, ‘ডিয়ার গানপাগল’। তখনো দলের নাম দেওয়া হয়নি।

২০১৪ সালে দল করল ‘গানপাগল’। বেছে বেছে বাংলা গান করে তারা। কথা, সুর ও ভাব ঠিক রেখে নতুন সংগীতায়োজনে করে লোকগান, ঐতিহ্যবাহী বাংলা গান, পুরোনো চলচ্চিত্রের গান। শুরু থেকেই পরিকল্পনা ছিল, তাঁদের গানে থাকবে শাস্ত্রীয় সংগীতের ঘ্রাণ, বাদ্য হবে অ্যাকোয়েস্টিক।

কদিন আগের কথা। ওআইসি দেশগুলোর নেতারা সেদিন ঢাকায়। রাষ্ট্রপতির বাড়িতে নৈশভোজের আগে গানপাগল ধরল ‘ময়ূরপঙ্খি ছুইটা চলে দিলে লাগে রং’। বরিশাল অঞ্চলের নৌকাবাইচের গান এটি। বিদেশি নেতাদের সামনে দেশকে উপস্থাপনের জন্য এর চেয়ে ভালো গান আর কী হতে পারে? দলের বেহালাশিল্পী শিউলি সেই গল্প বলতে গিয়ে জানান, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগানগুলোই বেছে বেছে গাইছেন তাঁরা। প্রতিটি অঞ্চলের গানের কথা ও সুর আলাদা। সেসব নিয়েই কাজ করতে চান তাঁরা। গানের বাণী ও সুর ঠিক থাকবে, সংগীতায়োজন করা হবে নতুন করে। এখনকার সংগীতায়োজনে নানা রকম স্বেচ্ছাচারিতা আছে। ফলাফল—গানের ভাব নষ্ট হয়। খরাপীড়িত ভাওয়াইয়া গানে ধুমধাড়াক্কা বিট সংযোজন করলে সেটা সংগীতায়োজন হয়? শিউলি বলেন, ‘আমাদের লোকঐতিহ্য অনেক ঋদ্ধ। আমরা সেটা নিয়েই এগোতে চাই। শাস্ত্রীয় সংগীতের উৎপত্তি লোকসংগীত থেকেই। শাস্ত্রীয় সংগীতকে বৃন্দবাদন সহযোগে দলীয় প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত।’

নতুন সংগীতায়োজন ও লোকগানের শাস্ত্রীয় রূপ? যন্ত্রসংগীতে (বেহালা) পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা শিউলি বলেন, ‘পিচঢালা এই পথটারে’ মূল গানটা ও আমাদের করা গানটা শুনলেই বুঝবেন। কিংবা আবদুল আলীমের ‘শোনো গো রূপসী কন্যা গো’ গানটায় বেহালার কাজ। আমাদের লোকগানগুলোতে ভৈরবী, খাম্বাজ, কাফি, ঝিঞ্ঝটিসহ আরও অনেক রাগের ছায়া পাওয়া যায়। এসব গানে আধুনিক গানের মতো সংগীতায়োজন করা যায় না। গানের ভাব ও রাগের সঙ্গে সংগীতায়োজন মানানসই না হলে, মূল শিল্পীর অমর্যাদা হয়।

একটা শক্ত মূল্যবোধের ধারক হওয়ায় মন জোগানোর গান করা হয় না গানপাগলের। শিল্পী ও শ্রোতা প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে গানপাগলের শিল্পী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষক শোয়েব বলেন, ‘গান যেহেতু গুরুমুখী বিদ্যা, সবার সেভাবেই শেখা উচিত। অন্যদিকে শ্রোতাদেরও মৌলিক সংগীত বুঝতে হবে। শুদ্ধ সংগীত শোনার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।’ শ্রোতাদের অবস্থা নিয়ে ব্যক্তিগত এক অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে শোয়েব বলেন, ‘এক আসরে মান্না দের চৌদ্দটা গান করার পর এক শ্রোতা বললেন, মান্না দের একটা গান শোনাবেন?’

যে গানে মানুষের হৃদয়ের কথা, সমাজ-সংস্কৃতির কথা থাকবে না, যে গান মানুষকে ভাবাবে না, গানপাগল সেই গান করে না। তারা মনে করে, গুরুপরম্পরায় শেখা ও শেখানোই হচ্ছে সংগীতশিক্ষার উত্তম উপায়। এ প্রক্রিয়ায় গুরুর সঙ্গে আড্ডা হবে, কথা হবে, হবে দীর্ঘ ভাব বিনিময়। দর্শন, রস নিয়ে আলোচনা হলে পরে আত্মিক উন্নয়ন ঘটবে। এভাবেই তৈরি হয় একজন শিল্পী। এ ভাবনাগুলো অন্যদের ভেতর সংক্রমণ করতে চায় গানপাগল।