স্যমন্তক সবখানে!
ঢাকার মানুষের আতিথেয়তা, আন্তরিকতায় কতটা মুগ্ধ হয়েছেন, তা ঢাকা থেকে ফিরে কলকাতায় গিয়ে ফেসবুকে লিখেছিলেন। মাঝে কিছুদিন কেটে গেছে। এত দিনে ভালো লাগার রেশ কেটে যাওয়ারই কথা! তা যে একদমই কমেনি, বরং ঢাকার খাবার, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার কথা দিয়ে কলকাতার ‘ফার্স্ট ফ্লাশ’ নামের ক্যাফেতে শুরু হলো সংগীতশিল্পী স্যমন্তক সিনহার সঙ্গে আলাপচারিতা।
এবার প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসেছিলেন। গানের বন্ধু সাহানা বাজপেয়ী আসার উপলক্ষ ও স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝরের গানের কাজের জন্য তিনি কলকাতা থেকে ঢাকা চলে আসেন। ঢাকার বেঙ্গল বইয়ে সাহানা বাজপেয়ীর সঙ্গে গানের সন্ধ্যায় স্যমন্তকও তাঁর এ দেশের ভক্তদের নিরাশ করেননি। শ্রোতাদের অনুরোধে দুটি গান গেয়ে শোনান। গান শেষে সাড়া দেখে বোঝা গেছে ঢাকায় তাঁর জনপ্রিয়তা।
বাংলাদেশের প্রতি একধরনের আত্মিক টান আছে স্যমন্তকের। ‘আমি যখন স্কুলে পড়ি, তখন থেকে ব্যান্ডসংগীতের দিকে ঝোঁক। গিটার শিখেছি। বাংলাদেশের শিল্পী জেমসের ভীষণ ভক্ত আমি। সাউন্ডটেক থেকে যে ক্যাসেটগুলো বের হতো, সেগুলো কিনে শুনতাম।’ শুনছিলাম স্যমন্তকের কথা।
ছোটবেলা থেকে গানের পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন। তাঁর বাবা শখে গান গাইতেন। বাবার কণ্ঠে, সুন্দর গায়কিতে বাড়িতে শুনেছেন দেবব্রত বিশ্বাসের রবীন্দ্রসংগীত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানগুলো। আর ক্লাস এইটে কি নাইনে পড়ার সময় থেকে পাড়ার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বন্ধুরা মিলে গাইতেন। তবে সব সময়ই গান শুনলে কিশোর স্যমন্তকের শরীর-মনে আলোড়িত হতো।
কলেজে পড়ার সময় তাঁর এক দাদা বিশ্বসংগীতের সঙ্গে পরিচয় করালেন। জন ডেনভার, বব ডিলান, পিট সিগার, স্করপিয়নস, পিংক ফ্লয়েড, মহীনের ঘোড়াগুলি শুনে স্যমন্তক ভাবলেন, তিনি তো এমন গানই করতে চান। আর সে সময় কলকাতায় ক্যাকটাস, ফসিলস ব্যান্ড নিজেদের মেলে ধরছে। এসব আর বন্ধুদের অনুপ্রেরণায় কলেজে পড়ার সময় এমটি স্পেসেস নামে একটি ব্যান্ড গড়ে তোলেন। নিজেরা গান তৈরি করতেন। সেই এমটি স্পেসেস অবশ্য এমটি (শূন্য) হয়ে গেছে। স্যমন্তক ছাড়া বাকিরা অন্য পেশায় চলে গেলেন। স্যমন্তক বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বিজ্ঞাপন—এগুলোতে গেয়ে চলেছেন তখন। হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক শেষ করে কিছুদিন চাকরি করেছিলেন। স্যমন্তক অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁকে দিয়ে চাকরি হবে না। সংগীতই তাঁর সব।
এরপর ২০০৯ সালের দিকে কলকাতার বিশিষ্ট সংগীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র একদিন স্যমন্তককে তাঁর স্টুডিওতে ডাকেন। ভারতীয় চ্যানেল স্টার জলসায় ঋতুপর্ণ ঘোষের চিত্রনাট্যে, অভিনেতা প্রসেনজিতের প্রযোজনায় দেবজ্যোতি মিশ্রের সংগীতায়োজনে ‘গানের ওপারে’ নামে একটি টিভি ধারাবাহিকে গান গাইতে বলা হলো। যদিও তখন এত কিছু জানতেন না স্যমন্তক। তাঁকে গাইতে বলা হলো, তিনি গাইলেন। গানের ওপারের নায়ক গোরার কণ্ঠে যে রবীন্দ্রসংগীতগুলো শুনতে পেয়েছিল সবাই, সেগুলোর নেপথ্যের কণ্ঠশিল্পী ছিলেন স্যমন্তক। গানের ওপারে তাঁকে নতুনভাবে মানুষের সামনে নিয়ে এল। শুধু তা-ই নয়, তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রসংগীতগুলো এই প্রজন্মের তরুণেরা, বয়োজ্যেষ্ঠরা পছন্দ করলেন। জনপ্রিয়তা স্যমন্তককে আরও দায়িত্বশীল করে দিয়েছিল। গান নিয়ে আরও সিরিয়াস হলেন। ২০১৪ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিলের চার্লস ওয়ালেস বৃত্তি নিয়ে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ও সাউন্ড প্রোডাকশন বিষয়ে পড়াশোনা করতে গেলেন লন্ডনে। কলকাতায় গানবাজনা সাত মাস বন্ধ থাকলেও লন্ডনে নতুন করে বিশ্বসংগীতের সন্ধান পেলেন যেন। সেখানকার অনেক বড় বড় সংগীতজ্ঞের সঙ্গে কাজ করার সুযোগও হলো স্যমন্তকের। লন্ডনে যাওয়ার আগে ও পরের বিষয়টি এমন—আগে নিজের লেখা গান, সুর যেভাবে করতে চাইতেন, অনেক সময় অন্যরা তা বুঝতেন না। এখন যেহেতু নিজেই কাজটি পারেন, ফলে মনের মতো করে গান তৈরি হয়।
রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে নিরীক্ষা করলে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় অনেককে। এ বিষয়ে স্যমন্তকের মন্তব্য কী? বেশ ব্যাখ্যা করে বললেন, যেহেতু কপিরাইটের সমস্যা নেই, তাই নিরীক্ষা করা যেতে পারে। শিল্পীর স্বাধীনতা আছে। মূল সুর, কথা ঠিক রেখে সংগীতায়োজনে কিছুটা নিরীক্ষা করলে কখনো ভালো হবে, কখনো অত ভালো হবে না। সমালোচনাকে ইতিবাচকভাবে নিতে হবে। আর গানের ওপারেতে আমি যেভাবে গান গেয়েছিলাম, সেটি সিরিয়ালের প্রয়োজনে করেছি।
‘গানের ওপারে’র কারণে অনেকে মনে করতেন, স্যমন্তক শুধু রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী। নিজের মৌলিক গান দিয়ে ১৫-২০টির মতো সিনেমায় প্লেব্যাক করে নিজের শিল্পীসত্তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। ২০১০ সাল থেকে ‘স্যমন্তক অ্যান্ড মেটস’ নামে নতুন ব্যান্ড তৈরি করেছেন। নতুন সংগীতায়োজনে ‘স্যমন্তক অ্যান্ড মেটস’ পুরোনো দিনের বাংলা গান যেমন, ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’, ‘কী নামে ডেকে বলব তোমাকে’ এবং বেশ কয়েকটি লোকগীতির মিউজিক ভিডিও বানিয়েছেন। জনপ্রিয়তা পেয়েছে গানগুলো। আর স্যমন্তকের লেখা ও সুর করা মৌলিক গান তো আছেই। তাঁর ভাষায়, মূলত মৌলিক গানই আমি করতে চাই। এ ছাড়া বন্ধুদের অনেকের লেখা গান, কবিতায় মিউজিক কম্পোজ করছি, সংগীতায়োজন করছি, গাইছি।
নানা ধরনের গান শুনতে, গানের কথা লিখতে বেশি ভালোবাসেন। কবির সুমন, অঞ্জন দত্ত, মৌসুমী ভৌমিক, অর্ণব, রূপম ইসলাম ও সাহানা বাজপেয়ীর গান তাঁর প্রিয়। এখন পর্যন্ত নিজের কোন গান সবচেয়ে প্রিয়? ঝটপট উত্তরে বললেন, পরবাসে। এটা একটু অন্য ধরনের গান। সম্পর্কের অন্ধকার দিকটা কিছুটা আছে, কোথাও আত্মোপলব্ধি খুঁজে পাই…।
একটু হেসে বললেন, ‘আমি একটু কষ্টের গান গাইতে পছন্দ করি। যুগে যুগে কষ্টের গানগুলো মানুষের মনে থেকে গেছে।’
স্যমন্তক এখন রবীন্দ্রভারতীতে রবীন্দ্রসংগীতের ওপর স্নাতকোত্তর করছেন। আর পুরোদমে চলছে কাজ। ‘কিয়া অ্যান্ড কসমস’ নামে একটি সিনেমার মিউজিক করছেন, একই সঙ্গে সাহানা বাজপেয়ীর একটি একক গান, স্যমন্তকের নিজের একক গানের কাজ, বাংলাদেশের এনামুল করিম নির্ঝরের লেখা গান গাইছেন, মিউজিক করছেন। চলছে বাংলাদেশের সংগীতশিল্পী জয়িতার নিজের লেখা গানের সংগীতায়োজনের কাজও।
ব্যক্তি স্যমন্তক রাস্তায় হাঁটতে, চায়ের দোকানে চা খেতে, সাঁতার কাটতে, ঘুরতে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে ভালোবাসেন। যদিও সেসব আড্ডায় মিতভাষী স্যমন্তক বেশির ভাগ সময় ভালো শ্রোতা হিসেবে থাকেন। আর বাড়িতে পিমপমের সঙ্গে (স্যমন্তকের পোষা প্রাণী) কাটানো সময়গুলো উপভোগ করেন। মা-বাবার একমাত্র সন্তান স্যমন্তক প্রচুর বই পড়েন, সিনেমা দেখেন। সঙ্গে সব সময় বই থাকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মিলান কুন্ডেরা রয়েছেন প্রিয় লেখকের তালিকায়।
ভক্তদের নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন না? ‘আমার ভক্তরা খুব ভালো। আমাকে বিব্রত করে না।’ স্যমন্তকের ভক্তদের জন্য জানিয়ে রাখি, তিনি সহজে বিরক্তও হন না, রেগেও যান না।
জানতে চাই, চারজন সদস্যের ‘স্যমন্তক অ্যান্ড মেটস’-এর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? ‘নতুন নতুন ধরনের গান করতে চাই। তবে এটা ঠিক, কোনো কিছু জীবনে অত পরিকল্পনা করে করিনি। সবকিছুই হুট করে হয়েছে।’
এক কাপ চা শেষ হয়ে দ্বিতীয় কাপের চাও শেষের দিকে। আমাদের আলাপচারিতাতেও রাশ টানতে হলো। গানের স্যমন্তক দুই বাংলা ও সারা বিশ্বে গানপ্রিয় মানুষের কাছে আরও যেতে চান। ঢাকাবাসীকে সুযোগ পেলেই গান শোনাতে আসবেন—তাঁর প্রিয় খাবার বিরিয়ানি খেতেও! আর তাঁকে তাঁর নিজস্ব ওয়েবসাইটে গেলে তো নাগালেই পেয়ে যাবেন। সুরের আগুন ছড়িয়ে দিতে স্যমন্তক আছেন সবখানে।