শুনতে কি পাও: টুকরো ভাবনা

শুনতে কি পাও ছবির দৃশ্য
শুনতে কি পাও ছবির দৃশ্য

মনে খানিকটা কুয়াশা নিয়ে কামার আহমদ সাইমন পরিচালিত ও সারা আফরিন প্রযোজিত চলচ্চিত্র শুনতে কি পাও দেখতে বসি। ইউরোপের একটি উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কারের পতাকা নিয়ে ছবিটি হাজির। আনন্দের কথা। কিন্তু জানি, ছবিটির বিষয়বস্তু দেশের একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ঘিরে। এ-ও জানি, বাংলাদেশের দারিদ্র্য আর দুর্যোগ পশ্চিমাদের খুব পছন্দের বিষয়। ফলে, ঠিক কোন বাংলাদেশের কথা শুনিয়ে কামার পশ্চিমাদের স্বীকৃতি এনেছেন, সেই সন্দেহের কুয়াশা জেগে থাকে মনে। পশ্চিমারা সব সময় সঠিক কারণে যে আমাদের প্রশংসা বা নিন্দা করে, তা তো নয়। ছবিটি শুরু হলে টের পাই, মনের কুয়াশা একটু একটু করে কাটছে।

২০০৯ সালে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে বিধ্বস্ত একটি গ্রাম ও তার বাসিন্দা একটি পরিবারের জীবনযাপনের ঘটনা নিয়েই শুনতে কি পাও। ঝুঁকি থাকে দুর্যোগপীড়িত জনপদকে নিয়ে তৈরি ছবি দুর্গত মানুষের অসহায়ত্ব ও দুর্দশার একটি সেন্টিমেন্টাল ক্লিশে বয়ান হয়ে উঠতে পারে, হতে পারে নেহাতই শুষ্ক এক প্রতিবেদন। কামার এই ঝুঁকি এড়িয়েছেন। উপস্থাপনায়, বিষয়-ভাবনায় চিন্তাকে উসকে দেওয়ার নমুনা রেখেছেন ছবিটির নানা স্তরে। ডকুমেন্টারি ও ফিচার ফিল্মের নানা উপাদানের আন্তপ্রজননের চেষ্টা মনোযোগ কাড়ে।

লক্ষ করি, উপদ্রুত উপকূলের মানুষের মানবেতর জীবনের প্রদর্শনীর মাধ্যমে দর্শকের করুণা ও দীর্ঘশ্বাস উদ্রেকের কোনো চেষ্টা এ ছবিতে নেই, বরং আছে দুর্যোগবিধ্বস্ত জনপদ বিষয়ে একটি বিকল্প বয়ান তৈরির উদ্যোগ। পরিচালক জোর দিয়েছেন অসীম পরাক্রমশালী প্রকৃতির পাশে ক্ষুদ্র মানুষের সীমাহীন শক্তির ওপর। যেন গ্রিক পুরাণের আদিম মানুষ এক নাজুক প্রাণী হিসেবে রুদ্র প্রকৃতির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, যার প্রকাণ্ড থাবা নেই, বিশাল দাঁত নেই, তীক্ষ নখ নেই, ওড়ার পাখা নেই। দুর্বল সেই প্রাণী প্রমিথিউসের চুরি করা আগুন দিয়ে ক্রমেই বশ করে ক্ষমতাধর এই প্রকৃতিকে এবং নিজেই তৈরি করে এক দ্বিতীয় প্রকৃতি। আইলাবিধ্বস্ত ছবির মানুষগুলো যেন প্রমিথিউসের আগুন লাগা একেকজন আদিম মানুষ। সর্বস্ব হারিয়ে যৌথ উদ্যোগে তারা তৈরি করছে তাদের দ্বিতীয় প্রকৃতি। দলবেঁধে ঘুরিয়ে দিচ্ছে নদীর গতিপথ, নিচ্ছে খাবার, বাসস্থান ও আশ্রয়ের মতো একেবারে আদিম চাহিদাগুলো পূরণের উদ্যোগ। সুলতানের ছবির কথা মনে পড়ে আমাদের। জীবনের শেষ সম্বল হারানো এই জনপদের মেয়েরা অতীত প্রেমের স্মৃতি নিয়ে আড্ডা দেয়, নতুন শাড়ি পরে; পুরুষেরা গান শোনে, আয়োজন করে খেলার প্রতিযোগিতা। এটি ঠিক হেমিংওয়ের বুড়োর একা হাঙরের সঙ্গে লড়াইয়ের গল্প নয়। এ গল্প প্রকৃতি নামে হাঙরের সঙ্গে যৌথ মানুষের লড়াইয়ের।

সমান্তরালে শুনি এক দম্পতির ব্যক্তিগত গল্পও, যাদের সদ্য গড়ে তোলা সংসার লন্ডভন্ড হয়ে গেছে আইলার আঘাতে। সেই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে পৌরাণিক পাখির মতো ফুঁড়ে উঠতে দেখি রাখী নামের মেয়েটিকে। এই বিষম বাস্তবতায় ন্যূনতম উপকরণ দিয়েই রাখী চমৎকার বজায় রাখে তার গৃহিণীপনা, সন্তানকে ভরিয়ে রাখে মায়ায়, স্বামীকে দেখায় নতুন দিনের স্বপ্ন। নিজের সংসার ছাপিয়ে দায়িত্ব নেয় বিধ্বস্ত জনপদের শিশুদের শিক্ষারও। এ ছবির আরেকটি ব্যতিক্রমী মাত্রা শিশুর চোখ দিয়ে দুর্যোগকে দেখার চেষ্টা। এমন দুর্গত পরিস্থিতিতে শিশুরা কী করে উদ্যাপন করে তাদের শৈশব, ছবিটি তার খোঁজ দেয় আমাদের।

বিধ্বস্ত সেই গ্রামে ‘হতদরিদ্র’ মানুষকে ত্রাণ দিতে উপস্থিত হয় রাষ্ট্রও। কিন্তু প্রকৃতির প্রলয়ে সবাই যখন একাকার, তখন কে হতদরিদ্র আর কে নয়—হারিকেনের আলো-আঁধারিতে চা-খানায় বসে গ্রামের মানুষ এই ধাঁধার জন্ম দেয়। আমরা দেখি, এই চরম বিপর্যয়ের মধ্যে দাঁড়িয়েও ভাঙা স্কুলঘরে শিশুরা উচ্চ স্বরে পাঠ নেয় রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের দায়িত্ব, তারা দেশপ্রেমের গান গায়। একটা চাপা বেদনা ও কৌতুক মিশে থাকে এসব দৃশ্যে।

এস্টাবলিশিং শটে উলুধ্বনিসহ দূর থেকে সন্ধ্যার গ্রাম যেভাবে পর্দায় ভেসে ওঠে, তাতে শুরুতেই দর্শককে গেঁথে ফেলার শক্তি আছে ছবিটির। এই লং শট থেকে মুহূর্তে আমরা চলে যাই ক্লোজ শটে রাখী আর তার সন্তানের মশারির ভেতর। এভাবে বৃহৎ ইমেজ থেকে ক্ষুদ্র ইমেজ, সেখান থেকে আবার বৃহৎ ইমেজে চলাচল করে ছবিটি। দূর চরাচর, নদীর ছোট স্রোত ক্রমেই বড় স্রোতে পর্যবসিত হওয়া ইত্যাদি টুকরো টুকরো ইমেজে প্রকৃতি একটি চরিত্র হিসেবে উপস্থিত এই ছবিতে। প্রকৃতিকে ক্যামেরা একবার কাছ থেকে দেখায়, একবার দূর থেকে; একইভাবে দেখায় মানুষকেও। মানুষ আর প্রকৃতি, দুই প্রতিদ্বন্দ্বী চরিত্র যেন। সম্পাদনার মুনশিয়ানায় এ দুইয়ের ভেতর একটা চাপা প্রতিযোগিতা তৈরি হয়, তৈরি হয় নাটকীয়তা।

ছবির শেষে মনের কোণে কিঞ্চিৎ কুয়াশা অবশ্য ঝুলে থাকে। সহসা মনে হয়, ঘুরে দাঁড়ানো লড়াকু দুর্গত মানুষের স্বর শোনাতে গিয়ে এই আইলাবিধ্বস্ত চরাচরে যে গভীর আর্তনাদ আর গোমড়ানো কান্নার স্বর আছে, সেগুলোকে সযত্নে নীরবতার আড়ালে রেখে দেওয়া হয়েছে যেন। এ প্রশ্ন জাগে আরও এই কারণে যে কাহিনির কেন্দ্রে যে নারীকে আমরা দেখি, সে শিক্ষিত, মোটামুটি সচ্ছল হিন্দুধর্মাবলম্বী একজন। কামার তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, স্পটে গিয়ে অগণিত নারীর ভিড়ে ঘোমটাবিহীন ঋজু এই নারী তাঁর চোখে পড়ে। সেই সুত্রে তাকে প্রধান চরিত্রে নির্বাচন করেন তিনি। রাখীর বিপরীতে গ্রামটির একেবারেই অশিক্ষিত, অতিদরিদ্র, ঘোমটাপড়া রক্ষণশীল আবহে বেড়ে ওঠা কোনো মুসলিম নারীর আইলা অভিজ্ঞতা ও স্বর ভিন্ন হবে বলে ধারণা করা যায়। রাখীর ঋজুতা ও স্বচ্ছন্দ চলাচলের পেছনে তার শিক্ষা, তুলনামূলক সচ্ছলতা, পর্দার বাধামুক্ত ধর্মাচরণ ইত্যাদিও বিবেচনার দাবি করে। পর্দায় রাখীর গল্প তুলে আনলেও পর্দার আড়ালে সমান্তরাল বহু পর্যুদস্ত নারীর গল্পও প্রচ্ছন্ন আছে ছবিটিতে, এমন একটা ইঙ্গিত পাওয়া গেলে স্বস্তি হতো।

কামার ও সারা দম্পতির আছে মেধা, তারুণ্য ও চলচ্চিত্রের প্রতি গভীর ভালোবাসা, যার স্বাক্ষর তাঁরা রেখেছেন তাঁদের প্রথম ছবি স্টোরিজ অব চেঞ্জ ও দ্বিতীয় ছবি শুনতে কি পাও-এ। আন্তর্জাতিক পুরস্কার ইত্যাদি তাঁদের আত্মতৃপ্ত না করে তুললে তাঁদের কাছ থেকে আমরা ভবিষ্যতে আরও চমৎকার ছবি পাব বলে বিশ্বাস করি।