'অস্তিত্বসংকট' গানের ভুবনে!

সিডির ক্রেতাদের মতো, সিডির দোকানও এখন বিলুপ্তপ্রায়। সিডি বিক্রেতারা অনেকেই এখন ব্যবসা বদলে অন্যদিকে ঝুঁকেছেন। ছবি: প্রথম আলো
সিডির ক্রেতাদের মতো, সিডির দোকানও এখন বিলুপ্তপ্রায়। সিডি বিক্রেতারা অনেকেই এখন ব্যবসা বদলে অন্যদিকে ঝুঁকেছেন। ছবি: প্রথম আলো

একদিকে অডিও বাজারে মরা গাঙ, অন্যদিকে প্রযুক্তির ভরা জোয়ার। কপিরাইট আইন লঙ্ঘন হচ্ছে হরহামেশা। এসব নিয়ে দেশের সংগীতাঙ্গনে এখন নিদারুণ অরাজকতা। শিল্পী, সুরকার, গীতিকারের পরস্পর পাল্টাপাল্টি অভিযোগ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। আবার গান পরিবেশনের জন্য উন্মুক্ত সংগীত আয়োজন (ওপেন এয়ার কনসার্ট) দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। পরিস্থিতিকে ‘অস্তিত্বের সংকট’ বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

রাজধানীর পাটুয়াটুলী, নবাবপুর কিংবা চট্টগ্রামের রেয়াজউদ্দিন বাজার, খুলনার নিউমার্কেটের অডিও সিডির বাজারে এখন আর নতুন বা পুরোনো গানের অ্যালবাম বিক্রি হয় না। ব্যবসা পাল্টিয়েছেন অনেক বিনিয়োগকারী। ঈদ উপলক্ষে এখন আর শত শত নতুন অ্যালবাম প্রকাশ করে না প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো। গত ১০ বছরে শুধু যে অডিও বাজার তার জৌলুশ হারিয়েছে তা নয়, শ্রোতাও কমে গেছে বলে দাবি প্রযোজকদের। প্রবীণ শিল্পীদের মধ্যে এই নিয়ে ক্ষোভ আগে ছিল, এখনো আছে। কেউ কেউ বলছেন, ‘যথেষ্ট চর্চার অভাব। শিল্পীর সঙ্গে গীতিকার ও সুরকারের কোনো সমন্বয় নেই।’

২০০০ সালের পর প্রথম ধাক্কা লাগে নকল সিডি ও অবৈধভাবে এমপিথ্রি ফরম্যাটে গান বক্রির কারণে। এতে বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রকৃত প্রযোজক ও পরিবেশকেরা। একটা সময় পাইরেসি বন্ধে হাইকোর্ট বিশেষভাবে নির্দেশ দিলেও শেষ পর্যন্ত তা রক্ষা করা যায়নি। ওই সময়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সাউন্ডটেকের উদ্যোক্তা সুলতান মাহমুদ তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘একটি সংঘবদ্ধ চক্র ঢাকায় এ ব্যবসা চালু করেছিল। চক্রটি ব্যান্ড মিউজিকের সদ্য মুক্তি পাওয়া সিডিগুলো “এমপিথ্রি” বানিয়ে বাজারজাত করত। একসঙ্গে ১০ বা ১২টি অ্যালবামের গান প্রযুক্তিগত সুবিধা ব্যবহার করে এক সিডিতে চোরাইভাবে বাজারজাত করত। এতে যেসব প্রতিষ্ঠান বৈধভাবে বাজারজাত করেছে, তারা পড়েছিল লোকসানের মুখে। যে কারণে পরে আর ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।’

লেজার ভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাজহারুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শুধু আমাদেরই নয়, দেশের অডিও-ভিডিও বাজারের ৮০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল অবৈধভাবে। লাখ লাখ টাকা, মেধা, শ্রম বিনিয়োগ করে বাকি ২০ শতাংশ বিক্রি করছেন বৈধ ব্যবসায়ীরা।’

অডিও বাজারের ক্ষেত্রে দেশে কপিরাইট আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই বলে দাবি করছেন শিল্পীরা। এ আইনে বলা হয়েছে, সিডি, ভিসিডি কিংবা চলচ্চিত্রের একটি কপি জমা দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে আগারগাঁওয়ের কপিরাইট অফিসে গিয়ে। কিন্তু এ ব্যাপারে উদাসীন শিল্পীরা।

এর ফলে দিনে দিনে গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীদের মধ্যে গানের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব বা বিতর্ক বাড়ছে। যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে, কপিরাইট ও রয়্যালটির বিষয়ে শিল্পীরা সচেতন নন। এ বিষয়ে টাস্কফোর্স থাকলেও গত দুই বছরে কোনো অভিযোগ আসেনি কপিরাইট অফিসের টাস্কফোর্সে। তাই ইচ্ছা থাকলেও পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না বলে প্রথম আলোকে জানালেন কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী। কপিরাইট নিয়ে ব্যান্ডদল মাইলস, শিরোনামহীন, দ্য ট্রাপের অভিযোগগুলো নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এর বাইরে বড় ধরনের অভিযোগ নেই।

গানের গীতিকারদের অবমূল্যায়ন করা হয় বলে প্রায় শোনা যায়। তাঁদের মতে, সুরকারের কাজ যেমন সুর করা, শিল্পীর কাজ গাওয়া, তেমনি গীতিকারের কাজ লেখা। আইয়ুব বাচ্চু ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘হাসতে দেখ গাইতে দেখ’, জেমসের ‘জেল থেকে বলছি’, ‘প্রিয় আকাশি’, ‘পালাবে কোথায়’, তপন-শাকিলার দ্বৈত ‘তুমি আমার প্রথম সকাল’সহ অনেক জনপ্রিয় গানের গীতিকার লতিফুল ইসলাম শিবলী বলেন, ‘৯০ দশকে আমার লেখা গান করে অনেক ব্যান্ডশিল্পী জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। ওই সময় আমি গানগুলোর যথাযথ সম্মানী পাইনি। পরবর্তী সময় ওই সব গানের রয়্যালটি থেকেও বঞ্চিত হয়েছি। গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক সবার প্রচেষ্টাতেই একটি গান তৈরি হয়, এ কথা অবশ্যই মানতে হবে। কিন্তু যে লেখাটা নিয়েই এত কিছু, সেই লেখকের অবমূল্যায়ন হবে কেন!’

নব্বইয়ের দশকে কনসার্টকেন্দ্রিক উন্মাদনা ছিল ব্যাপক। গত ১০ বছরে কনসার্ট আয়োজনের রীতিও কমে গেছে। আয়োজক প্রতিষ্ঠান অন্তর শোবিজের উদ্যোক্তা স্বপন চৌধুরী বলেন, ‘নিরাপত্তা অজুহাতে প্রশাসন ধীরে ধীরে ওপেন এয়ার কনসার্টের ওপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অনুমতি পাওয়া যায় না সহজে। ফলে এখন আমরা কনসার্ট আয়োজন কমিয়ে দিয়েছি।’

বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘অস্তিত্বের সংকট’ বলে মনে করেন দেশের সংগীত দল ও সংগীত একাডেমিগুলোর জাতীয়ভিত্তিক সংগঠন বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি তপন মাহমুদ। তাঁর মতে, এখন বাংলাদেশের সংগীতজগতের সার্বিক অবস্থা মোটেও ভালো নয়, দুঃসময় যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতিতে আমাদের শিল্পী, সুরকার, যন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে এ পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য ভেবেচিন্তে উদ্যোগ নেওয়া খুব জরুরি। বিশ্ব সংগীত দিবস উদ্যাপনটা এর একটা উপলক্ষ হতে পারে।’