বেতার নির্বাসনে যায়নি

বেতারের স্টুডিওতে মহড়ায় ব্যস্ত (বাঁ থেকে) সুবর্ণা মুস্তাফা, আজাদ আবুল কালাম, তারিক আনাম খান ও মনোজ সেনগুপ্ত। গত মঙ্গলবার।
বেতারের স্টুডিওতে মহড়ায় ব্যস্ত (বাঁ থেকে) সুবর্ণা মুস্তাফা, আজাদ আবুল কালাম, তারিক আনাম খান ও মনোজ সেনগুপ্ত। গত মঙ্গলবার।

ক্লান্ত দুপুরে বিশ্রাম নিতে নিতে কানের কাছে ছোট্ট রেডিও সেট রেখে নাটক শোনার স্মৃতি হয়তো অনেকেরই আছে। বিশেষ করে এখন যাঁরা যুবক কিংবা প্রৌঢ়। স্যাটেলাইট আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যস্ততার এই যুগে অনেক দিন হয়তো শোনা হয়নি বেতারের নাটক। ভাবছেন, নির্বাসনে গেছে বেতারের নাটক?

মোটেও না। কান পেতে নাটক শোনার দিন এখনো আছে। নির্বাসনে যায়নি বেতার, বেতারের নাটক। এখন দেশের তারকা শিল্পীদের কণ্ঠ শোনা যায় বেতারে। নানা মাধ্যমে শোনা যায় বেতারের সম্প্রচার। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নানা উদ্যোগ চালু করেছে কর্তৃপক্ষ।

গত দুই দিনের কথা শুনি। মঙ্গল ও বুধবার আগারগাঁওয়ের শেরেবাংলা নগরে বাংলাদেশ বেতার ভবনে রীতিমতো তারকার মেলা বসেছিল। এসেছিলেন মামুনুর রশীদ, রাইসুল ইসলাম আসাদ, শম্পা রেজা, তারিক আনাম খান, সুবর্ণা মুস্তাফা, মনোজ সেনগুপ্ত, আজিজুল হাকিম, আজাদ আবুল কালাম, হৃদি হক, তমালিকা কর্মকার, নাজনীন চুমকির মতো সুপরিচিত শিল্পীরা।

এবারের তারকা মেলার উপলক্ষ ছিল ঈদের নাটক। বেতারের বাণিজ্যিক কার্যক্রম এবার কোরবানি ঈদে পরপর তিনটি নাটক করবে। নাটকগুলো হচ্ছে মাসুম রেজার ‘চিনি মহল্লা’, মান্নান হীরার ‘অসমাপ্ত গল্প’ এবং তারিক মনজুরের ‘কোরবানি ও বিবাহ সমাচার’। বাণিজ্যিক কার্যক্রমের উপপরিচালক নাসিমা বেগমের পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধানে নাটকগুলো প্রযোজনা করেছেন সৈয়দা ফরিদা ফেরদৌসী। প্রযোজক জানালেন, ঈদের দিন থেকে শুরু করে পরপর তিন দিন বেলা ৩টা ৫ মিনিটে এফএম ১০৪ ও ৬৩০ এএমে নাটকগুলো প্রচার করা হবে।

ইতিমধ্যে জাতীয় বেতার ভবনের ধারাবাহিক নাটক তারিক মনজুর রচিত ‘রেবা ও তার বিড়াল’ দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। নিয়মিত এই নাটকে তারকা শিল্পীরা অংশ নেন। গেল ঈদে বিশেষ পর্বেও মামুনুর রশীদ, সুবর্ণা মুস্তাফা, তারিক আনাম খানের মতো জনপ্রিয় শিল্পীদের কণ্ঠ শোনা গেছে। নাটকটি বেশ সাড়া ফেলেছে বলে জানালেন বেতারের কর্মকর্তারা। নিয়মিত বেতার শোনেন—এমন কয়েকজন শ্রোতাও নাটকটির প্রশংসা করেছেন। জাতীয় বেতার ভবনের নাটকটি মূলত শিশুতোষ ধারাবাহিক, প্রতি শনিবার সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে প্রচারিত হচ্ছে এফএম ১০৬-এ।

বেতারের মঞ্চনাটক ধারণের পাশাপাশি বেতার ভবনের মিলনায়তনে নাটকটি সরাসরি দেখারও ব্যবস্থা করেছে কর্তৃপক্ষ। গত ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যা সাতটায় বাংলাদেশ বেতারের ঢাকা কেন্দ্রে মঞ্চস্থ হয় আরণ্যক নাট্যদলের ‘ভঙ্গবঙ্গ’। সেদিন সন্ধ্যায় রীতিমতো উৎসবমুখর পরিবেশ ছিল বেতার কেন্দ্রে। ২০০ আসনের অত্যাধুনিক মিলনায়তনটির সব আসন ভরে গিয়েছিল। বেতারের ঢাকা কেন্দ্রের আঞ্চলিক পরিচালক সায়েদ মোস্তফা কামাল বলেন, ‘এখন থেকে নিয়মিতই মঞ্চনাটক সরাসরি পরিবেশনের পরিকল্পনা আছে। জুলাইয়ে এ নিয়ে আমরা নতুন সূচি তৈরি করতে পারব।’

বেতারের বর্তমান নাটকের কার্যক্রমগুলোয় অংশ নিচ্ছেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘একসময় রেডিওই ছিল আমাদের একমাত্র অবলম্বন, রেডিও থেকে শিখেছি। এত বছর পর এই যুগেও বেতার নাটককে জনপ্রিয় করার জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।’

কথা হলো বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক নারায়ণ চন্দ্র শীলের সঙ্গে। কিছুটা আক্ষেপের সুরেই বললেন, ‘একটা কথা প্রচলন হয়ে গেছে, এখন নাকি কেউ বেতার শোনে না। অথচ আমরা সময়ের সঙ্গে তাল রেখে প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলেছি।’

মহাপরিচালক বলেন, ‘বেতারের সার্বিক কার্যক্রমকে সময়োপযোগী করার জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন মুঠোফোন অ্যাপসের সাহায্যে বেতারের নানা কার্যক্রম শোনা যাচ্ছে। ফেসবুকে লাইভ হচ্ছে। অনলাইনে অডিও আর্কাইভে শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন স্বাদের গান। নিয়মিত-অনিয়মিত অনুষ্ঠানের আগে-পরে ট্রাফিক কার্যক্রমও প্রচারিত হচ্ছে। দেশের নানা প্রজন্মের প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় শিল্পীরা আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন। এমনকি আমেরিকা থেকে একটি নির্দিষ্ট নম্বরে ডায়াল করে কোনো কলচার্জ ছাড়াই শোনা যাচ্ছে বেতারের অনুষ্ঠান।’

ধ্বনি বিস্তার কেন্দ্র নামে এ দেশে প্রথম স্বল্পপরিসরে বেতারের কার্যক্রম শুরু হয়। মূলত, ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর নাজিমুদ্দিন রোডের ভাড়া করা বাড়িতে ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ নামে বেতারের সম্প্রচার কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬০ সালে শাহবাগস্থ কেন্দ্রে বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে এটি আগারগাঁওয়ে শেরেবাংলা নগর থেকে কার্যক্রম চালাচ্ছে।