সাবধান ফেক আইডি!

তারকাদের পেছনে লাখ লাখ ভক্ত-দর্শক ছুটবেন, এটাই স্বাভাবিক। তারকাদের কাজের বা সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা তো ভক্তরাই। কিন্তু এই ভক্তদের কেউ কেউ নকল তারকা সেজে ফেসবুকে ফেক আইডি খোলেন। আসল তারকার আইডি ভেবে এসব ফেক আইডির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে অনেকেরই। তাঁরা হন প্রতারণার শিকার। এতে কখনো কখনো বিড়ম্বনায় পড়ে যান আসল তারকারা। সংগীত, নাটক ও চলচ্চিত্রের বেশ কয়েকজন তারকার এ ধরনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন শফিক আল মামুন


বছর দুয়েক আগের ঘটনা। নির্মাতা রেদওয়ান রনির নামে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলেছেন এক তরুণ। শুধু আইডি খুলেই ক্ষান্ত হননি, অভিনয়ের কথা বলে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। বিষয়টা আসল রেদওয়ান রনি জানতে পেরে আইনের আশ্রয় নিয়েছিলেন। থানা-পুলিশ করে অবশেষে আটক হয়েছিল নকল ‘রেদওয়ান রনি’। এমন বিড়ম্বনায় শুধু নির্মাতা নন, তারকারাও পড়েন অহরহ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে যেকোনো এক তারকার নাম লিখে সার্চ দিন, পেয়ে যাবেন অসংখ্য আইডি। আরিফিন শুভর কথাই ধরুন। তঁার নামে শ খানেক আইডি আছে ফেসবুকে। যার একটি মাত্র আইডির মালিক আরিফিন শুভ। অন্যগুলোর ছবি আর নাম ঠিক থাকলেও চালায় নকল আরিফিন শুভরা। এত এত আরিফিন শুভর যমজ আইডির ভিড়ে আসল শুভকে চেনা কঠিনই। স্বয়ং শুভ মনে হয় মাঝেমধ্যে ধন্দে পড়ে যান কিনা কে জানে। শুধু ফেসবুক আইডি নয়, আছে ভুয়া ফ্যান পেজও। যেখানে হাজার হাজার অনুসারী অনুসরণ করছেন তাঁকে।

শুভ জানালেন, প্রতিদিনই তাঁর পেজের অ্যাডমিনদের দিয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করেও কোনো কাজ হচ্ছে না। শুভ বললেন, ‘এক দিক দিয়ে রিপোর্ট করে বন্ধ করা হয়। আরেক দিক দিয়ে খোলা হয়। তাই একেবারে বন্ধ করা মুশকিল।’ জানালেন, ফেক আইডি ব্যাপার নয়। কিন্তু কোনো কোনো সময় তারকার নাম–ছবি ব্যবহার করে নকল আইডি থেকে আসল তারকার ভক্তদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়। এ কারণে বিড়ম্বনায় পড়ার ঘটনাও ঘটেছে অনেক তারকার বেলায়। এ নিয়ে থানা-পুলিশও করতে হয়েছে তারকাদের।

এমনই একটি ঘটনার কথা জানালেন আরিফিন শুভ। বছর দেড়েক আগে তাঁর নিজের নাম ব্যবহার করে এক আইডি থেকে একটি ছেলে একাধিক মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করেন। মেয়েদের কাছ থেকে উপহার, এমনকি টাকাপয়সাও নিয়েছেন ছেলেটি। আরিফিন শুভ বলেন, ‘ছেলেটি আমার কণ্ঠ অবিকল নকল করে ওই সব মেয়ের সঙ্গে কথা বলত। মেয়েদের কাছ থেকে টাকা ও উপহার নেওয়ার সময় ধরা পড়ার ভয়ে ছেলেটি নিজে না গিয়ে তার কাজিনকে পাঠাত। আমার ফ্যান পেজ অ্যাডমিনদের কাছ থেকে বিষয়টি জানার পর তো আমি আকাশ থেকে পড়ি! অনেকটাই বোকা হয়ে গিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত সাইবার ক্রাইমের একটি ইউনিটের সহযোগিতায় ছেলেটাকে খুঁজে বের করে সমাধান করেছি।’

কণ্ঠশিল্পী ইমরান মাহমুদুলের নামেও শত শত ফেক আইডি আছে। এক ছেলে ফেক আইডি থেকে বিদেশে বসবাসরত ইমরানের এক মেয়ে ভক্তের সঙ্গে প্রতারণারও খবরও পাওয়া গেছে। মেয়েটির সঙ্গে ওই ছেলেটি ছয় মাস ধরে প্রেমও করেছেন। ইমরান বলেন, ‘একটা পর্যায়ে আইডিটি নিয়ে সন্দেহ হলে মেয়েটি দেখা করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু ছেলেটি মেয়েটির মুখোমুখি হলে তো ধরা পড়ে যাবেন, এ জন্য বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে দেখা করতেন না। একসময় ছেলেটি স্বীকার করেন যে, তিনি ইমরান নয়, ইমরান সেজে এত দিন কথা বলে আসছেন। এরপর মেয়েটি ওই ফেক আইডি ব্লক করে দিয়েছেন। প্রেমের সম্পর্কও ভেঙে গেছে।’

ইমরান বলেন, ‘এসব বিষয়ে ভক্তদের সচেতন হতে হবে। কেননা ফেসবুকে তারকার আইডির অনুসারী দেখলেই তো আসল-নকল আইডি বোঝা যায়।’

আরেক সংগীতশিল্পী দিলশাদ নাহার কনার নামে ফেসবুকে অর্ধশতাধিক ফেক আইডি আছে। এসব ফেক আইডির কারণে তাঁকেও কখনো কখনো বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে কনা বলেন, ‘গত বছর আমার একটি নতুন গানের ভিডিও বের হওয়ার পর এক ভক্ত ফোন করে আমাকে বললেন, ‘‘আমি আপনাকে ১৮টা গান দিলাম, একটা গানও তো করলেন না।’’ এ কথা শুনে আমি তো থ। আবার বলেন ‘‘আপনার সঙ্গে তো আমার চ্যাটিংও হয়েছে।’’ পরে বুঝলাম এটি ফেক আইডির কাজ। তাঁকে আমি বোঝাতেই পারছিলাম না যে আমার সঙ্গে তাঁর কথা হয়নি।’

কনা আরও বলেন, ‘আমার নামে ফেক আইডিগুলো হয়তো আমার ভক্তরাই খোলেন। কিন্তু এই ফেক আইডি দিয়ে এক ভক্ত আরেক ভক্তের সঙ্গে এভাবে প্রতারণা করেন, এটা খুব খারাপ লাগে।’

অসংখ্য ফেক আইডি ও ফেক ফ্যানপেজ খোলা হয়েছে ছোট পর্দার অভিনেত্রী মেহ্জাবীন চৌধুরীর নামেও। তিনি বলেন, ‘আমার ফ্যান পেজ যাঁরা দেখাশোনা করেন, তাঁরা আমাকে জানিয়েছেন আমার নামে অসংখ্য ফেক আইডি খোলা হয়েছিল। এ পর্যন্ত রিপোর্ট করে করে অনেকগুলো বন্ধ করা হয়েছে। বন্ধ করা হলেও আবার নতুন করে কেউ না কেউ খুলছেন। কী আর করা।’

মেহ্জাবীন আরও বলেন, ‘আমার ভক্তরা অনেক সময় না বুঝে এই সব ফেক আইডিতে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে বন্ধু হন। এভাবেই প্রতারণার ফাঁদে পড়েন।’ তিনি বলেন, ‘আমার পেজ ভেরিফাইড হওয়ার পর অনেকই সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেন না। অনেক ভক্তই এখন আসল-নকল আইডি বুঝতে পারেন।’

তবে নকল আইডি চেনার অনেক উপায় আছে। তারকাদের বেশির ভাগ পেজ ভেরিফাইয়েড। আইডির নামের পাশে নীল চিহ্ন দেখলে নিশ্চিত হওয়া যাবে পেজটি ভেরিফায়েড। এ ছাড়া সাম্প্রতিক ছবি বা কাজের খবর দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় আইডিটি আসল। এমন আইডির বন্ধু বা অনুসারী হওয়ার অনুরোধ করেন তারকারা।

ভুয়া অ্যাকাউন্ট চিনবেন কীভাবে?
ভুয়া অ্যাকাউন্ট নিয়ে তারকাদের বিড়ম্বনার কথা ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ভালো করেই জানে। ভক্তদের বিভ্রান্তি দূর করতেই জনপ্রিয় তারকাদের প্রোফাইলে নামের পাশে ছোট্ট টিক চিহ্ন জুড়ে দিয়ে স্বীকৃতি জানানোর রীতি চালু আছে ফেসবুকে। এই চিহ্নের নাম ‘ভেরিফায়েড ব্যাজ’। ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট কিংবা পেজে ভেরিফায়েড ব্যাজ থাকা মানে সেই অ্যাকাউন্টটি আসল। আপনি নিশ্চিন্তে অনুসরণ করতে পারেন।

তবে বাংলাদেশে সব তারকার অ্যাকাউন্টে ভেরিফায়েড ব্যাজ নেই। সে ক্ষেত্রে কোন অ্যাকাউন্টটি আসল আর কোনটি নকল, তা জানতে আপনাকে শার্লক হোমসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে না। শুধু মাথায় রাখুন এই বিষয়গুলো:

* প্রোফাইলের পরিচয় ছবিতে। প্রোফাইলে যদি বহুল ব্যবহৃত পুরোনো কোনো ছবি থাকে কিংবা ছবির মান যদি খারাপ হয়, সেই অ্যাকাউন্ট ফেক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আবার তারকারা সাধারণত নিয়মিত ছবি পোস্ট করে থাকেন। তাই টাইমলাইনে পোস্ট করা ছবিগুলোতেও নজর বোলাতে পারেন।

* তারকারা সাধারণত ফেসবুকে নিজের কাজের হালনাগাদ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুভূতি বা মতাদর্শ শেয়ার করেন। কোনো প্রোফাইলে গিয়ে যদি দেখেন, সমান তালে পণ্য বা ওয়েবসাইটের লিংক শেয়ার করা হয়েছে, ধরে নিতে পারেন সেটি ফেক অ্যাকাউন্ট।

* নিজের নামের বানান সাধারণত কেউ ভুল করে না। তাই নামের বানান দেখুন। অবশ্য একই নামে অ্যাকাউন্ট খোলা অসাধ্য কোনো কাজ না। সে ক্ষেত্রে প্রোফাইল লিংকে ইউজার আইডি (www.facebook.com/...) দেখতে পারেন।

* তারকাদের অনুসারীর সংখ্যা বেশি হয়ে থাকে। কোনো তারকার প্রোফাইলে গিয়ে যদি দুই থেকে দশ লাখ অনুসারী দেখেন, তবে সে অ্যাকাউন্ট আসল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

* ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সক্রিয় রাখুন। প্রোফাইল বা পেজে গিয়ে এমন কোনো কিছু যদি চোখে পড়ে যা সে তারকার সঙ্গে ঠিক যায় না, তবে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কেই প্রাধান্য দিন।

* অনেক তারকা ফেসবুকে কাছের বন্ধুদের মধ্যে থাকতেই ভালোবাসেন। তাঁদের টাইমলাইনে পোস্টগুলো লুকোনো থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে কীভাবে বুঝবেন অ্যাকাউন্টটি আসল না নকল? বোঝার দরকার নেই। তাঁদের বিরক্ত করবেন না।
মেহেদী হাসান