ক্যানসার, লড়াই, বেঁচে থাকা

হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর, ১৯৪৮-১৯ জুলাই, ২০১২)। ছবি: নাসির আলী মামুন. ফটোজিয়াম
হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর, ১৯৪৮-১৯ জুলাই, ২০১২)। ছবি: নাসির আলী মামুন. ফটোজিয়াম
আজ হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুবার্ষিকী। ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে তিনি চলে গেছেন পৃথিবী থেকে। এই রোগের সঙ্গে লড়াই করেছেন অনেক তারকাই। অনেকেই হয়েছেন পরাজিত, অনেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। আজকের এই দিনে হুমায়ূন আহমেদসহ ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করা এ উপমহাদেশের আরও কয়েকজন তারকাকে স্মরণ করে বিশেষ এই লেখা।

 
‘আমি শিওর, একদিন ক্যানসারমুক্ত পৃথিবী হবে।’—হুমায়ূন আহমেদ এ কথা বলেছিলেন নাসির আলী মামুনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। হুমায়ূন আহমেদের সেই সাক্ষাৎকারটি প্রথম আলো পত্রিকাতেই ছাপা হয়েছিল। কর্কট রোগের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের সময়টায় অনেক লেখাতেই তিনি তাঁর রোগ নিয়ে লিখেছেন নানা কথা। ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ নিয়ে তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর অনুভূতি, তাঁর মানসিক চাপের কথাও। কিন্তু এই রোগ লেখককে ভাঙতে পারেনি। ক্যানসারের কাছে হার মানলেও আজ থেকে ৬ বছর আগে এই নন্দিত কথাসাহিত্যিক মারা যান একটি ক্যানসারমুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন চোখে নিয়ে।

এই কর্কট রোগটা হুমায়ূন আহমেদের মতো আমাদের আরও অনেক প্রিয় ব্যক্তিত্বের জীবনকে সংকটে ফেলেছে। অনেকে এই সংকট উতরে জয় করেছেন ক্যানসারকে, অনেকে আবার ক্যানসারের সঙ্গে লড়তে লড়তে হার মেনেছেন জীবনের কাছে। অভিনেত্রী দিতি, সংগীতশিল্পী লাকী আখান্দ, শাম্মী আখতার, নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম, শহীদুল ইসলাম খোকন, অভিনেতা চ্যালেঞ্জারের মতো চেনাজনদের চলে যাওয়া এখনো দর্শক-শ্রোতাদের মনে ক্যানসারকে এক ভয়ংকর খলনায়কের ভূমিকায় আমাদের সামনে দাঁড় করিয়েছে। যেন একে হার মানানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবে সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন, সংগীত পরিচালক আলম খান, ভারতের মনীষা কৈরালার ক্যানসারজয় কিংবা অর্থহীন ব্যান্ডের সুমন আর সংগীতশিল্পী ফুয়াদের ক্যানসারের সঙ্গে লড়াইয়ের সাহসী চেষ্টা অনেককে অনুপ্রাণিত করে।

মাসখানেক আগেই বলিউড অভিনেতা ইরফানের ক্যানসার ধরা পড়ে। এর থেকেই রীতিমতো আড়ালে চলে যান এই অভিনেতা। চিকিৎসার জন্য তিনি এখন যুক্তরাজ্যে আছেন। সময়ে সময়ে নিজের স্বাস্থ্যের খোঁজ দিচ্ছেন, তবে খ্যাতির আলো থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছেন তিনি। কারণ, এই রোগটা নাকি তাঁর জীবনকে এক অদ্ভুত অনিশ্চয়তার মুখে নিয়ে গেছে। অন্যদিকে আরেক বলিউড অভিনেত্রী সোনালী বেন্দ্রেও কিছুদিন আগে নিজের শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ার বিষয়টি জানিয়েছেন সবাইকে। বলেছেন, সবার ভালোবাসা ঢাল হিসেবে নিয়ে তিনি ক্যানসারের সঙ্গে নেমেছেন যুদ্ধ করতে। তিনি এখন আছেন যুক্তরাষ্ট্রে ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য। ইরফান ও সোনালী দুজনই গত কয়েক দিনে বুঝিয়ে দিয়েছেন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করার জন্য দ্রুত চিকিৎসার পাশাপাশি প্রচণ্ড মানসিক শক্তিরও প্রয়োজন, প্রয়োজন ভালোবাসা ও প্রার্থনার।

এখনো অভিনেতা আলী যাকের, অর্থহীন ব্যান্ডের সুমন, সংগীতপরিচালক ফুয়াদ আল মুক্তাদির ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছেন। তবে এই প্রক্রিয়াকে তাঁরা অনেকেই আলোচনায় আনতে চান না। কারণ হিসেবে অনেকে বলেন, চিকিৎসার এই প্রক্রিয়া ও সময়টা একজনের জীবনকে দুমড়ে-মুচড়ে রেখে দেয়। শুধু একজন নয়, এই রোগের প্রভাব পড়ে পুরো পরিবারের ওপর। কিন্তু রোগটিকে যখন জয় করে আসেন একজন, তখন সেটা অনুপ্রেরণা আর দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায় সবার জন্য। তাই তো কিছুদিন আগেই নিজের ক্যানসার-যুদ্ধ নিয়ে বলিউড অভিনেত্রী মনীষা কৈরালা বলেছেন, ‘সুখকর চিন্তার মধ্যে থেকে লড়তে হবে ক্যানসারের সঙ্গে। লুকিয়ে নয়, লড়াই করতে হবে সবার সামনে এসে। যা ভালো লাগে তাই করে জীবনটাকে উপভোগ করতে হবে। এভাবেই চিকিৎসার জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে।’ একই সুর কিন্তু আমাদের হুমায়ূন আহমেদের লেখাতেও ছিল। তিনিও তাঁর মানসিক চাপ মোকাবিলার জন্য নিউইয়র্কে ক্যানসারের চিকিৎসা চলার সময় হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম আর কাগজ। কর্কট রোগটি সে সময় এক নতুন চরিত্র হয়ে তাঁর নানা লেখায় জায়গা করে নিয়েছিল। তাই এখনো নতুন করে যখন কোনো চেনাজন এই রোগের কবলে পড়েন, তখন ঘুরেফিরেই হুমায়ূন আহমেদের সেই যুদ্ধদিনের কথা তাঁর পাঠকদের মনে পড়ে যায়।

এক জীবনঘাতী রোগ হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে গেছে। তিনি বেঁচে আছেন তাঁর সৃষ্টির মাঝে। শিল্পী বেঁচে থাকেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই। হুমায়ূন আহমেদও সেভাবেই বেঁচে থাকবেন আরও বহু বহু দিন।

ইরফান খান, সুমন
ইরফান খান, সুমন

ক্যানসার নিয়ে অনেকে অনেক কথাই বলেন। এ রোগের সঙ্গে লড়াই করা ব্যক্তিরা কষ্টকর এই সফর নিয়ে সহজে মুখ খুলতে চান না। তবে ক্যানসারজয়ী অভিনেত্রী মনীষা কৈরালা নিজের রোগমুক্তির পর থেকে বেশ সরব। তিনি সম্প্রতি ক্যানসার বিষয়ে কিছু চরম সত্য কথা বললেন। যা আপনারাও জেনে রাখতে পারেন। কারণ, সময় কখন কার প্রতিকূলে চলে যায়, তা কি আর বলা যায়? এ জন্য ক্যানসার নিয়ে মনীষার ৫ সত্য বচন তুলে ধরা হলো এখানে। তাঁর কঠিন সময়ে যে বিষয়গুলো তাঁকে কষ্ট দিত, সেগুলো তিনি একে একে বলেছেন।

১. অনভিজ্ঞদের উপদেশ
যে জিনিসটি ক্যানসারের চিকিৎসার সবচেয়ে কম দরকার, সেটা হলো উপদেশ। একজন মানুষ যিনি জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে আছেন, তাঁকে অহেতুক উপদেশ দিতে যাবেন না দয়া করে। এমন পরিস্থিতিতে তিনিই উপদেশ দিতে পারেন, যাঁর নিজের ক্যানসারের সঙ্গে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা আছে।

মনীষা কৈরালা
মনীষা কৈরালা

২. বাজে চিন্তা কোরো না
মনীষাকে এ কথা তাঁর ক্যানসারের সময়টায় অনেকেই এসে বলত। তখন মনীষার মনে হতো, ‘আমি কি সব সময় বাজে চিন্তা করি? তাই এই পরিণতি?’ মনীষার ভাষায়, কোনো কর্কটাক্রান্ত ব্যক্তিকে এমন প্রশ্নের মুখে দাঁড় না করানোই ভালো। এমন উপলব্ধি তাঁদের মানসিক শান্তির ব্যাঘাত ঘটায়।

৩. ‘এটা কি দুরারোগ্য?’
খোদ রোগীকেই অনেকে না জেনে এই প্রশ্ন করে ফেলে। আর নায়িকা হওয়ার সুবাদে তো মনীষাকে এ প্রশ্নের মুখে আরও বেশি পড়তে হয়েছে। তাই সুস্থ হওয়ার পর তিনি সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেছেন, ‘একজন ভুক্তভোগী নিজেই এমন সংকটের মধ্য দিয়ে যায়, যে এই রোগটা কোনো দিন সারবে কিনা, এটা জিজ্ঞেস করা মানে, তাকে আরও ভেঙে দেওয়া।’

৪. ‘তোমাকে তো ক্যানসার রোগীদের মতো অসুস্থ দেখায় না!’
মনীষা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ভালো কিছু ভেবে একজন এ কথা বললে আমি তা ভালোভাবেই নিই। তবে কেউ এটা উপলব্ধিও করতে পারবে না যে, আমাদের জার্নিটা কত কঠিন ও লম্বা। তাই চেহারা দেখে একজনের অবস্থাকে বিচার না করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।’

৫. ‘যা হয়, ভালোর জন্যই হয়’
মনীষা কৈরালার শোনা সবচেয়ে অপ্রিয় উপদেশ এটা। ক্যানসারের চিকিৎসা চলার সময় মনীষা কৈরালাকে কেউ এ কথা বললেই তিনি জবাবে বলতেন, ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। আমি উপদেশ চাই না।’