লেখকের চোখে হাসপাতাল

আর সি মজুমদার আর্টস মিলনায়তনে বক্তৃতা দেন কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান।
আর সি মজুমদার আর্টস মিলনায়তনে বক্তৃতা দেন কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান।

পরিদর্শনে আসবেন অধ্যাপক সাহেব। খবর আসা মাত্র বদলে যায় ওয়ার্ডের চিরচেনা পরিবেশ। রীতিমতো লাঠিপেটা করে সরিয়ে দেওয়া হয় রোগীর আত্মীয়স্বজনকে। যেন মঞ্চস্থ হচ্ছে কোনো নাটক, রোগীরা দর্শক। তবে চুপচাপ নাটকটি দেখতে হবে। টুঁ শব্দটি করলে ধমক খেতে হবে।

চিকিৎসক, নার্স, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, রোগী ও তাঁদের স্বজনদের নিয়ে বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোর একেকটি বিচিত্র রাজ্য। শাহাদুজ্জামান একে পর্যবেক্ষণ করেছেন একজন চিকিৎসক, নৃবিজ্ঞানী ও লেখকের চোখে। দেখেছেন, নিজ নিজ প্রেক্ষাপটে সবাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। যদিও এদের প্রতিটি পক্ষের প্রত্যেক ব্যক্তিরই রয়েছে নানা অভিযোগ। একক বক্তৃতায় গতকাল তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিজের সেই অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার আর্টস মিলনায়তনে ছিল কথাসাহিত্যিক ও নৃবিজ্ঞানী শাহাদুজ্জামানের একক বক্তৃতা ‘একটি হাসপাতাল: একজন নৃবিজ্ঞানী ও লেখকের চোখে’। যৌথভাবে এ আয়োজনটি করে রিডিং ক্লাব ট্রাস্ট ও জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশন।

হাসপাতালের অতসী কাচে শাহাদুজ্জামান দেখার চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশকে। তিনি বলেন, শুরুতে উপনিবেশ স্থাপনের জন্য ব্রিটিশরা এই অঞ্চলে হাসপাতাল তৈরি করে। যাঁদের দিয়ে নীল চাষ করিয়ে নেওয়া হবে, তাঁদের কলেরা, গুটিবসন্ত ও প্লেগ থেকে মুক্ত রাখার তাগিদে। মিশনারিজদের হাতে স্থাপিত হাসপাতালগুলোর কাজ ছিল ধর্মান্তরিত করা আর এখন করা হয় মুনাফার জন্য। অন্যদিকে অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার মধ্য দিয়ে দেশে পরিচালিত সরকারি হাসপাতালগুলো চলছে এক বিস্ময়কর নিয়মে।

একটি সরকারি হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগ নিয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে লেখক বলেন, হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে বেডের থেকে রোগীর সংখ্যা বেশি থাকে। অতিরিক্ত রোগীদের সেবা দেওয়ার সুযোগ থাকে না সেখানে। ওষুধ থেকে বালিশ—সবকিছুর জন্য বাড়তি অর্থ গুনতে হয় রোগীকে। তাঁদের ভোগান্তির অংশীদার হয় রোগীদের পরিবার। কখনো নার্স, কখনো পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তাঁরা।

হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সেখানে কাজ করেন নামমাত্র বেতনে। সেখানকার যাবতীয় তথ্য জানার কারণে বিপুল ক্ষমতা ধারণ করেন তাঁরা। টুকিটাকি সেবা ও তথ্যের বদলে বকশিশ না নিয়ে সংসার চালানো তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। অন্যদিকে পেশা হিসেবে নার্সিং এখনো এ দেশে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেনি। ফলে বাধ্য হয়ে এ পেশায় আসছেন নারীরা। শতাধিক রোগীর সেবা দেওয়ার জন্য অল্প কয়েকজন নার্সকে রাখা হয় বলে যথাযথ দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয় না তাঁদের পক্ষে।

চিকিৎসকদের প্রসঙ্গে শাহাদুজ্জামান বলেন, ‘পরিবারের কেউ ডাক্তার হলে সবাই গর্বিত বোধ করেন। কিন্তু চাকরির শুরুতে সামান্য বেতনে কাজ করতে হয় চিকিৎসকদের। যাপন করতে হয় দুর্দশাগ্রস্ত এক জীবন। একপর্যায়ে অবশ্য তাঁদের অবস্থার পরিবর্তন হয়। কিন্তু এর মধ্যে এক অসহনীয় জীবন কাটিয়ে আসতে হয় তাঁকে।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের পরিচালক আরিফ খান। সংগঠন দুটির ২৫তম মাসিক এ আয়োজনে বক্তৃতা শেষে শ্রোতাদের সংশ্লিষ্ট নানা প্রশ্নের উত্তর দেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের শিক্ষক শাহাদুজ্জামান। হাসপাতাল নিয়ে নিজের গবেষণা থেকে তিনি লিখেছিলেন ‘একটি হাসপাতাল একজন নৃবিজ্ঞানী কয়েকটি ভাঙ্গা হাড়’ বইটি। তাঁর দুটি গল্প থেকে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র ‘কমলা রকেট’।