'সুনাদ' এক অন্য রকম আয়োজন

এবার ছিল ‘সুনাদে’র প্রথম আয়োজন
এবার ছিল ‘সুনাদে’র প্রথম আয়োজন

দেশে উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রচার ও প্রসারে নানা উদ্যোগ নিয়েছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। সব থেকে বড় উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের আয়োজনের পাশাপাশি তারা সংগীতের নবীন ও প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের উচ্চাঙ্গসংগীতে আরও পারদর্শী করে তুলতে বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। গেল সপ্তাহে এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজন করা হয় উচ্চাঙ্গসংগীতের আসর ‘সুনাদ’। লিখেছেন মাসুম আলী

কে বলে এ প্রজন্ম কেবলই স্মার্টফোন, ট্যাব, ফেসবুকে ব্যস্ত! অনেকেই মনে করেন, এ প্রজন্ম উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রতি বিমুখ। ভাটা পড়েছে উচ্চাঙ্গসংগীতের ভুবনে। এ সবই গৎবাঁধা কথা। এ প্রজন্ম প্রস্তুত উচ্চাঙ্গসংগীতের ভুবনের বাসিন্দা হতে। শুধু সুযোগের প্রয়োজন। সেই বার্তাই পাওয়া গেল দুই দিনব্যাপী উচ্চাঙ্গসংগীতের আসর ‘সুনাদে’।

দুই দিনের এই সংগীত আসরে নবীন শিল্পীরা উজাড় করে দিলেন অমলিন সাধনার সুধা। এসরাজ, সেতারের অনবদ্য বাদনে আর কণ্ঠে খেয়ালের দারুণ পরিবেশনা দিয়ে নবীনেরা প্রমাণ করেন, উচ্চাঙ্গসংগীতের ভুবনে তাঁরা সম্ভাবনাময় বাসিন্দা। তাঁদের সেই উদ্‌যাপনের সাক্ষী থাকলেন স্থানীয় শ্রোতারা।

যেভাবে শুরু
এবার ছিল ‘সুনাদে’র প্রথম আয়োজন, তবে হঠাৎ নয়। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব হয় ২০১২ সাল থেকে। আয়োজনটি শুরুর কয়েক বছর পর তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেন শাস্ত্রীয় সংগীতের বিদ্যায়তন ‘বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়’। উদ্দেশ্য, দেশে শাস্ত্রীয় সংগীতের নতুন প্রজন্মের শিল্পী তৈরি। যাঁরা দীক্ষা নেবেন উপমহাদেশের উচ্চাঙ্গসংগীতের খ্যাতিমান গুরুদের কাছ থেকেই।

গুণীদের সান্নিধ্যে থেকে একটু একটু করে দেশে উচ্চাঙ্গসংগীতে নবীন শিল্পীরা আসছেন
গুণীদের সান্নিধ্যে থেকে একটু একটু করে দেশে উচ্চাঙ্গসংগীতে নবীন শিল্পীরা আসছেন

এ সুযোগটি কাজে লাগাতে চেয়েছেন অনেক তরুণ শিল্পীই। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশ নিতে নাম নিবন্ধন শুরু করেন ২০১৪ সালের নভেম্বরে। বাছাই পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হলো খেয়াল, ধ্রুপদ আর তবলার জন্য প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী। বাংলাদেশের সংগীতের ইতিহাসে শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়। বিদ্যার্থীদের যাঁরা নির্বাচন করলেন, শিক্ষাদান শুরু করলেন, তাঁরা বিশ্বখ্যাত সংগীতগুরুজন—পণ্ডিত উলহাস কসলকর, পণ্ডিত সুরেশ তালওয়ালকর, পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকর, পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার, পণ্ডিত কুশল দাশ। বিভাগীয় প্রধানের গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন শ্রীমতী সঞ্জিবনী কসলকর। বলাবাহুল্য, কিংবদন্তিতুল্য এই শিল্পীরা ভারতীয় নাগরিক। তাঁরা পালাক্রমে এসে বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের নবীন শিক্ষার্থীদের তালিম দেন।

এভাবে গুণীদের সান্নিধ্যে থেকে একটু একটু করে দেশে উচ্চাঙ্গসংগীতে নবীন শিল্পীরা আসছেন। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের গত কয়েকটি আসরে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা ছিল মনকাড়া।

সুনাদের মর্মকথা
‘সুনাদে’র দুই দিনের আসরের সঞ্চালনা করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। তিনি ব্যাখা করলেন, কেন সংগীত আয়োজনটির নাম ‘সুনাদ’। বললেন, ‘উপমহাদেশের সংগীতশাস্ত্রমতে ‘নাদ’ বলতে আদি ধ্বনিকে বোঝায়, যা থেকে সংগীত উদ্ভূত হয়েছে। “অনাহত নাদ” সেই শব্দ, যা স্বয়ম্ভু অর্থাৎ কোনো যন্ত্র বা কণ্ঠ দ্বারা নয়, নিজেই মনের ভেতর স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎপন্ন হয়। শিল্পীর ভেতর থেকে জেগে ওঠা সংগীতই পরম্পরা শিক্ষার্থীদের ব্রত হবে, এই আশা করেই আমরা এই কার্যক্রমের নাম দিয়েছি “সুনাদ”। আমরা বিশ্বাস করি, শিল্পকর্মের ভেতর থেকে যদি কোনো তৃপ্তি বা সার্থকতার বোধ শিল্পীর মনকে স্পর্শ না করে, তাহলে শিল্পীর মন দীপ্ত ও সৃষ্টিশীল থাকে না। শিল্পী একসময় ফুরিয়ে যান। তাঁর কাজ ক্লান্তিকর অনুবর্তনে পূর্ণ হয়ে ওঠে।’

আয়োজনের সাতকাহন
প্রথম দিন ১৭ সেপ্টেম্বর সোমবার নবীন শিল্পীদের উৎসাহ দিতে মঞ্চে এসেছিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সভাপতি আবুল খায়ের। তিনি শিক্ষার্থীদের উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। আয়োজনের উদ্দেশ্য জানালেন অল্প কথায়। বললেন, ‘যে আশা নিয়ে আমরা বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব শুরু করেছিলাম, তারই প্রতিফলন এই বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়, যা চার বছর ধরে চলছে। এরই মধ্যে আমাদের দুজন শিক্ষার্থী ভারতে পরিবেশন করে এসেছে। আশা করছি এই ধারাবাহিকতা আরও ভালোভাবে অব্যাহত থাকবে।’

আসরের প্রথম পরিবেশনায় দলীয় সরোদ বাদনে অংশ নেন ঈশরা ফুলঝুরি খান, ইলহাম ফুলঝুরি খান, সাদ্দাম হোসেন ও আরেফিন রনি। তাঁরা সমবেতভাবে ভূপালী রাগ পরিবেশন করেন। পরে মিরাজুল জান্নাত খেয়াল পরিবেশন করেন। তাঁর সঙ্গে সংগত করেন তবলায় প্রশান্ত ভৌমিক ও হারমোনিয়ামে আলমগীর পারভেজ। তৃতীয় পরিবেশনায় সুপান্থ মজুমদার তবলায় পেশকার, কায়দা, রেলা এবং টুকরা বাজিয়ে শোনান। প্রথম দিনের শেষ পরিবেশন রাগ-বাগেশ্রী (খেয়াল) পরিবেশন করেন অতিথি শিল্পী অলোক সেন। আমন্ত্রিত এ শিল্পীকে তবলায় সংগত করেন সবুজ আহমেদ এবং হারমোনিয়ামে মোহাম্মদ শাকুর, তানপুরায় দ্বীপ চন্দ্র দাস ও ধ্রুব সরকার।

প্রথম দিনের মতো দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবারও রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ছিল শ্রোতা-দর্শকে পূর্ণ। এদিনের শুরুতে মঞ্চে সেতার পরিবেশনা করেন সংগীতালয়ের শিক্ষার্থী প্রসেনজিৎ মণ্ডল, জ্যোতি ব্যানার্জি, জাহাঙ্গীর আলম শ্রাবণ, মোহাম্মদ কাওসার, সোহিনী মজুমদার, সামিন ইয়াসার ইফতি এবং সুব্রত বিশ্বাস। তাঁরা পরিবেশন করেন রাগ বেহাগ। সঙ্গে তবলা সংগত করেন সংগীতালয়ের শিক্ষার্থী প্রশান্ত ভৌমিক এবং সুপান্থ মজুমদার। এরপর মঞ্চে আসেন সংগীতালয়ের শিক্ষার্থী কানিজ হুসনা আহম্মাদী। তিনি কণ্ঠসংগীতে খেয়ালে রাগ মুলতানি পরিবেশন করেন। কানিজ হুসনার সঙ্গে তবলায় সংগত করেন শিক্ষার্থী প্রশান্ত ভৌমিক। হারমোনিয়ামে ছিলেন আলমগীর পারভেজ। ধ্রুপদ রাগ ছায়ানট পরিবেশন করেন অভিজিৎ কুন্ডু এবং টিংকু শীল। তাঁদের সঙ্গে পাখোয়াজে ছিলেন আলমগীর পারভেজ এবং তানপুরায় জ্যোতিশ্রী রায় ও ধ্রুব সরকার। আয়োজনের শেষ দিনের অন্তিম অধিবেশনে ছিল দলীয় ও একক এসরাজ বাদন। সৈয়দা রায়হান, রায়হানুল আমিন, রণজিৎ রায়, শুক্লা হালদার, ইসমাত আরা রুচি, শৌণক দেবনাথ ঋক, সৌমিত রায়, গৌরাঙ্গ কৃষ্ণ দাস এসরাজে রাগ ইমন পরিবেশন করেন। একক এসরাজ পরিবেশন করেন দেবাশীষ হালদার। তবলায় সংগত করেন সুপান্থ মজুমদার।

প্রতি মাসে আয়োজনের পরিকল্পনা
বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সংগীত বিভাগের ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপক তাজমি নূর জানিয়েছেন, পরিকল্পনা আছে এখন থেকে প্রতি মাসে উচ্চাঙ্গসংগীতের এ আসরটির আয়োজন করার। আগামী অক্টোবর মাসে পরের আসরটি হবে টাঙ্গাইলে। সেখানকার সংগঠন সরোজ পঞ্চমের সঙ্গে যৌথভাবে আয়োজন করা হবে এ আসরের।