কাজই আমাকে প্রণোদিত করে

বাকার বকুল
বাকার বকুল
তরুণ নাট্যকর্মী বাকার বকুল। অভিনয় ও নির্দেশনা দিয়ে নিজেকে চিনিয়েছেন। সম্প্রতি পেলেন ‘এস এম সোলায়মান প্রণোদনা ২০১৮’ সম্মাননা। কাজ করছেন দুরন্ত টিভিতে প্রযোজক হিসেবে। নাটক ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা হলো প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শরীফ নাসরুল্লাহ

অভিনন্দন। সম্মাননা পেয়ে কেমন লাগছে?

স্বীকৃতি সব সময়ই ভালো লাগে। আর স্বীকৃতিটা যদি নামাঙ্কিত থাকে বিশেষ কারও নামে, সেটা একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। প্রণোদনা আমার কাছে এমন নয় যে এখন থেকে খুব বেশি কাজ করতে হবে। কাজের ওপর খুব বেশি প্রভাব ফেলে না। তাহলে প্রভাবটা কোথায়? এটা প্রভাবিত করে আমার বন্ধুজন, পরিবারের লোকজনকে। তারা যখন এটা দেখে খুশি হয়, তখন মনে হয় এই প্রণোদনার একটা মানে আছে। আসলে থিয়েটার তো প্রত্যক্ষভাবে খুব কম ‘বেনিফিট’ দেয়। পরোক্ষভাবে তার একটা বিশাল প্রভাব থাকে। বাইরের লোকজন এটা বোঝে না। তারা মনে করে, জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। এসব সম্মাননা দেখলে তারা ভাবে, আমার সময় বৃথা যায়নি। তাঁরা আনন্দ পান। তবে এর জন্য আমার কাজের গতি বেড়ে যাবে কিংবা কমে যাবে—এমনটি নয়। কারণ, কাজই আমাকে প্রণোদিত করে।

থিয়েটারের শুরুটা কখন?

এলাকায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতাম। তখন ষষ্ঠ কি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। ছোট ছোট সংগঠন ছিল। ওগুলোর সঙ্গে কাজ করতাম। প্রচণ্ড খেলাধুলা করতাম। ফুটবল আমার স্বপ্ন ছিল। ফরিদপুরে আমি ফার্স্ট ডিভিশন খেলেছি। এর মধ্যেই এলাকায় কিছু নাটক করেছি। কলেজে এক বন্ধুর ডাকে একদিন নাটকের এক মহড়ায় আসি। এরপর মামুনুর রশীদের নাটক অববাহিকার মানু নামে একটা চরিত্র আমাকে দেওয়া হয়। যখন সেটি করলাম, তখন নির্দেশক বলেছিলেন, ওর কণ্ঠ ভালো, ওকে দিয়ে হবে। এই শুরু। তবে গ্রুপ থিয়েটারচর্চার শুরু হয় দেওয়ান গাজীর কিস্‌সা নাটক দিয়ে। ফরিদপুর থিয়েটারের হয়ে। ওদের শৃঙ্খলা দেখে ভালো লেগে যায়।

ঢাকায় কাজ শুরু করলেন কীভাবে?

প্রথমে স্বপ্নদল নাটকের দল দিয়ে শুরু করি। এরপর প্রাচ্যনাটে লাঠিখেলার প্রশিক্ষক হিসেবে ঢুকি। দলটাকে ভালো লেগে যায়। প্রাচ্যনাটের সঙ্গে যুক্ত হই।

আপনার নির্দেশিত প্রিয় নাটক কী? এবং অভিনয়ে প্রিয় চরিত্র কোনটি?

সব কটি নাটকই প্রিয়। প্রত্যেকটি নাটকই আমি উপভোগ করেছি। যেহেতু আমার প্রথম প্রযোজনা বন মানুষ। আমার কাছে মনে হয়েছে, এটার একটা ভিন্ন ইন্টারপ্রেটেশন আমি করেছি। আর প্রিয় চরিত্র বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রযোজনায় মোহাম্মদ জসীম উদ্দিনের নির্দেশনায় পুত্র নাটকের সিরাজ চরিত্রটি। ওটা আমাকে খুব ভাবিয়েছে।

এই সময়ে থিয়েটার দর্শকখরায় ভুগছে। এমন কথাবার্তা শোনা যায়। আপনার মত কী?

এটা একতরফাভাবে বলা যায় না। দর্শকের খরা আছে। তবে এটাও সত্য যে ভালো নাটক হলে মিলনায়তন ভরে যায়। নাটকের মতো একটা আর্টের ক্ষেত্রে আমি কখনোই প্রত্যাশা করি না যে একেবারে গণদর্শক এসে ভরে যাবে। কারণ মঞ্চনাটক দেখার জন্য ভেতরে একটা বোধ তৈরি হতে হবে। এটা না হলে এ ধরনের আর্ট দেখার অভ্যাসটা আসলে গড়ে ওঠে না। সামাজিকভাবে একটা মূল্যবোধের জায়গা তৈরি হলে আর্ট দেখার এমন অভ্যাস তৈরি হয়।

এ ক্ষেত্রে কি প্রচারের একটা কমতির কথা বলা যায়?

এটা একটা বড় অংশ। এখানে প্রচারের জায়গাটা অন্যান্য মাধ্যম যেভাবে উন্নত করছে, থিয়েটারটা সেভাবে করতে পারেনি। প্রচারমাধ্যমকে আমরা ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারিনি।

কয়টি নাটক নির্দেশনা দিয়েছেন ও অভিনয় করেছেন?

উল্লেখ করার মতো বলতে পারি—বন মানুষ, মুল্লুক, ঊর্ণজাল, লেটার টু আ চাইল্ড নেভার বর্ন এবং দুটি পরিবেশ থিয়েটার। এর বাইরেও ছোট ছোট কাজ করেছি। আর অভিনয়ের মধ্যে ত্রিংশ শতাব্দী, কাজল রেখা, আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ, রাজা এবং অন্যান্য, সার্কাস সার্কাস, মান্দার, পুত্র উল্লেখযোগ্য।

এই সময়ের থিয়েটারে সংকট ও সম্ভাবনা কী?

সংকট হলো—আমাদের প্রজন্মের সময় কমে গেছে। প্রতিনিয়ত তাদের সময় চুরি হয়ে যাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের একটা সুযোগ আমাদের আছে। কিন্তু এটা আমরা কীভাবে গ্রহণ করব, এর মধ্যে তা নিয়ে গলদ আছে। থিয়েটারের মতো একটা ধ্রুপদি শিল্প দীর্ঘদিন চর্চা করে করতে হয়। কিন্তু একটা ছেলের বড় সংকট হলো—সে এক কি দুই বছর নিয়মিত থিয়েটারে সময় দিল। পরবর্তীকালে রুটিরুজির জন্য যখন কোনো একটা কাজে তাঁকে ঢুকতে হয়, তখন সে আর সময় দিতে পারে না। আর সম্ভাবনার জায়গা হলো, এর মধ্য দিয়েও অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়েটার পড়ানো হচ্ছে। এটা একটা দুর্দান্ত সম্ভাবনা। অ্যামেচার থিয়েটারের প্র্যাকটিসের থেকে এখন সমৃদ্ধ একটা জায়গার দিকে যাচ্ছে। নতুন চিন্তার জায়গা তৈরি হচ্ছে।

তরুণ নাট্যকর্মীদের উদ্দেশে কী বলতে চান?

থিয়েটার আসলে স্বল্প সময়ে করার কাজ নয়। এটা একটা দীর্ঘ চর্চার কাজ। যদি ভালো লাগে, তাহলে মনোযোগ দিয়ে কাজটা করা জরুরি। সে যেখানে যেতে চায়, কাজটাই একটা সময় তাকে সেখানে পৌঁছে দেবে। সফলতার পেছনে দৌড়ানের দরকার নেই। নির্দিষ্ট লক্ষ্য ধরে কাজ করলে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় আপনা-আপনি পৌঁছে যাবে।