গণসংযোগের পাশাপাশি রিহার্সালে নূর

আসাদুজ্জামান নূর
আসাদুজ্জামান নূর

চেয়ারে বসে শিঙারা খাচ্ছিলেন গ্যালিলিও। তাঁর পেছনে টেলিস্কোপটি আকাশের দিকে তাক করা। ঠান্ডা লেগে গেছে, একটু পরপর নাক মুছছিলেন তিনি। শরীর তাঁর আগের থেকে ভালো। নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছেন। তীব্র মানসিক শক্তি তাঁর শারীরিক দুর্বলতাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে দিয়েছে। আবারও মঞ্চে দাঁড়াবেন তিনি, দুই বাংলার নন্দিত ‘গ্যালিলিও’ আলী যাকের। তাঁর সঙ্গে সেই চিরচেনা ‘অধ্যক্ষ’ আসাদুজ্জামান নূর। তাঁর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন সবাই।

গতকাল বুধবার সন্ধ্যা। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার চিলেকোঠার দ্বিতীয় মহড়াকক্ষে চাঞ্চল্য খেলে যায়। একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীকে সঙ্গে নিয়ে ঢোকেন আসাদুজ্জামান নূর। শুরু হয় গল্প, খুনসুটি। শিঙারা ও কফি খেতে খেতে চলতে থাকে আড্ডা। সামনে নির্বাচন। রাজনীতিবিদেরা মাঠে গণসংযোগে ব্যস্ত, আসাদুজ্জামান নূর মহড়াকক্ষে। নাট্যমঞ্চ থেকে রাজনীতির মঞ্চে গিয়েও স্বজনদের ছেড়ে যাননি তিনি। দূরে সরতে পারেননি নাটক থেকে। ছয় মাস আগে একটি টিভি নাটকে কাজ করেছিলেন, অনেক দিন পর। এবার করবেন মঞ্চে। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নাটক ‘গ্যালিলিও’ নবমঞ্চায়ন হতে যাচ্ছে আগামী ৫ অক্টোবর। নির্দেশনা দিচ্ছেন পান্থ শাহরিয়ার। তারই মহড়ায় হাজির হয়েছেন সবাই।

মহড়াকক্ষে আড্ডায় আলী যাকের, সারা যাকের ও আসাদুজ্জামান নূর
মহড়াকক্ষে আড্ডায় আলী যাকের, সারা যাকের ও আসাদুজ্জামান নূর

আলখাল্লাটা চাইলেন আলী যাকের। সেটি পরিয়ে তাঁকে ‘গ্যালিলিও’ সাজানো হলো। আসাদুজ্জামান নূর এসেছেন কচি কলাপাতা রঙের একটি পাঞ্জাবি পরে। বললেন, একজন উপহার দিয়েছে সেটা। তাঁর হাতেও একটি পাণ্ডুলিপি। সংলাপের অংশগুলো কাকতালীয়ভাবে তাঁর পাঞ্জাবির রঙের মার্কার দিয়ে দাগানো। অসীম ব্যস্ততা তাঁর। কেউ একজন বলল, ‘মহড়ায় থাকতে পারবেন?’ তিনি বললেন, ‘একবারে স্টেজে মারব।’

‘গ্যালিলিও’র চেয়ারে গিয়ে বসেন আলী যাকের। সামনে ছোট্ট গোল টেবিলে একটি নকল কালির দোয়াত, আপেল হিসেবে রাখা সাদা প্লাস্টিকের কাপ। ‘গ্যালিলিও’র সেট ডিজাইনার অপি করিম বেরিয়ে গেছেন ততক্ষণে। আয়নার সামনে চেয়ারে পাশাপাশি বসেছেন প্রযোজনা অধিকর্তা সারা যাকের ও আসাদুজ্জামান নূর। সারা যাকেরের পাশে মেঝেতে বসে ছিলেন নিমা রহমান, আসাদুজ্জামান নূরের প্রম্পটারের দায়িত্ব নিয়েছেন। কস্টিউম ডিজাইনে সারা যাকেরকেও সহযোগিতা করছেন তিনি।

নতুন করে মঞ্চায়নের অপেক্ষায় ‘গ্যালিলিও’তে থাকছেন পাঁচজন পুরোনো অভিনেতা—আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, কাউসার চৌধুরী, আবদুর রশিদ ও ফারুক আহমেদ। নতুনদের মধ্যে থাকবেন ফারহানা মিঠু, রিজভি আহমেদ, লাবণ্য, বাবলু, শাহিন, অভি, তনু প্রমুখ। আলোক পরিকল্পনা করেছেন নসিরুল হক খোকন।

সেই ১৯৮৮ সালের নাটক। কেমন করবেন নতুনেরা? আলী যাকের বলেন, ‘তাঁরা যদি বাইরের হতো, তাহলে ভাবার বিষয় ছিল। আমরা দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাজ করেছি। একে অন্যকে দীর্ঘদিন ধরে চিনি, তাদের অভিনয়ের শক্তি সম্পর্কে অবহিত আছি। সেহেতু ভালোই হবে। আর নির্দেশনাও বলতে গেলে একজন সিনিয়র আর্টিস্ট, পান্থ শাহরিয়ারের দেওয়া। সে জানে, যে যে চরিত্রের জন্য যাকে যাকে বাছা হয়েছে, তারা চরিত্রগুলোর সঙ্গে মিশে যেতে পারবে।’

‘গ্যালিলিও’ নাটকের মহড়ায় অংশ নিচ্ছেন শিল্পীরা
‘গ্যালিলিও’ নাটকের মহড়ায় অংশ নিচ্ছেন শিল্পীরা

‘গ্যালিলিও’ নাটকে তিনটি চরিত্রে অভিনয় করবেন আসাদুজ্জামান নূর—পোপ, অধ্যক্ষ ও বিচারপতি। একবার বললেন, ‘এত পার্ট দিয়েছ কেন আমাকে?’ মৃদু তাড়া ছিল তাঁর। বললেন, ‘সকালে নাটোর যেতে হবে।’ পাণ্ডুলিপির দিকে ইশারা করে নিমা রহমান বোঝাতে চাইলেন, ‘এটা নিয়ে যাবেন?’ নূর বলেন, ‘গাড়িতে যাব না তো।’ মনটা যতই পড়ে থাকুক মহড়াকক্ষ বা নাট্যমঞ্চে, ভেতরের চাপ চাপা রাখতে পারছিলেন না তিনি। এ সময় কীভাবে মহড়া করছেন? বলেন, ‘নির্বাচনের তফসিল এখনো ঘোষণা হয়নি। তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী প্রচারণার কাজ শুরু করব।’

সেই কবে শুরু করেছিলেন নাটকটি। এর মধ্যে কত-কী বদলে গেল। নাটকটির অভিনেতারা অভিজ্ঞতায় হয়েছেন আরও ঋদ্ধ। নাটকে এর প্রভাব থাকবে? আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘দর্শক বুঝতে পারে কি না জানি না, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চনাটকে কিন্তু পরিবর্তন হয়। একসময় আমাকে বলা হয়েছিল, এ নাটকে আপনি কমেডিয়ানের মতো করছেন কেন? তখন বলেছিলাম, আমাদের দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিরা যে রকম মেরুদণ্ডহীন, সরকারের সঙ্গে নীতিবিবর্জিত হয়ে আপস করে চলছে, সেটা আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়। অভিনয়টা সে জন্য ও রকম করার চেষ্টা করেছি। “গ্যালিলিও” হাজার বছর আগের ঘটনা। কিন্তু আমরা এখনকার ঘটনাগুলো মাথায় রেখে করেছি। যেমন এখানে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে কথা বলা হয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রগতিশীলতার পক্ষে কথা বলা হয়েছে। এ কথাগুলো তো আমাদের এখনকার কথা।’

‘সাগরেদো’র সংলাপ বলছিলেন কাউসার চৌধুরী, ‘ক্ষমতায় যারা আছে, সত্য জানা লোককে তারা পছন্দ করে না, হোক না সেটা দূরের নক্ষত্র সম্বন্ধে। তুমি কি মনে করেছ, তুমি যখন বলে বেড়াবে যে পোপের কথা ভুল, সে ভালো মানুষের মতো মেনে নেবে? একটু আগে টেলিস্কোপ দিয়ে তুমি যখন ওই নক্ষত্রগুলো দেখছিলে, আমি তোমাকে লক্ষ করেছি। আমি দিব্যচোখে দেখতে পেলাম তুমি জ্বলন্ত খড়ের ওপর দাঁড়িয়ে। যখন বললে তুমি প্রমাণে বিশ্বাস করো, তখন যেন পোড়া মাংসের গন্ধ পেলাম। বিজ্ঞানকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু তার থেকে বেশি ভালোবাসি তোমাকে। ফ্লোরেন্সে তুমি যেয়ো না গ্যালিলিও।’ এখানে নির্দেশক পান্থ শাহরিয়ার থামিয়ে দিলেন অভিনেতাকে। বললেন, ‘তার থেকে বেশি ভালোবাসি তোমাকে’ বলার সময় গ্যালিলিওর কাছাকাছি আসতে হবে, যেন তাঁকে আগলে রাখতে চাইছেন।

নাটকের জন্য পোশাক বানাবেন মাস্টার আলম। ফিতা দিয়ে সবার মাথার মাপ নিচ্ছিলেন তিনি। এ দলের অভিনেতাদের মাথার মাপ ঢাকার দর্শকদের জানা। মেধাবী এই অভিনেতারা যখন ‘গ্যালিলিও’ মঞ্চে এনেছিলেন, ঢাকায় তখন নাট্যমঞ্চই ছিল না। জার্মান সংস্কৃতি কেন্দ্রে আতাউর রহমানের নির্দেশনায় প্রথম এটি মঞ্চস্থ হয়। যাঁদের সৌভাগ্য হয়নি, তাঁরা নাটকটি দেখতে পাবেন আগামী ৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় বেইলি রোডের মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনের মঞ্চে। গঙ্গা যমুনা নাট্য উৎসব উপলক্ষে ১৪ অক্টোবর নাটকটি আবারও মঞ্চস্থ হবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে, জানালেন প্রযোজনা ব্যবস্থাপক ফখরুজ্জামান চৌধুরী।