অনন্য এক ভ্রমণ

সম্মেলনে িবভিন্ন দেশের অতিথিদের সঙ্গে পূজা সেনগুপ্ত (নিচের সারিতে বাঁ থেকে দ্বিতীয়)
সম্মেলনে িবভিন্ন দেশের অতিথিদের সঙ্গে পূজা সেনগুপ্ত (নিচের সারিতে বাঁ থেকে দ্বিতীয়)
>

চীনের ডান হুয়াং শহরে ‘আন্তর্জাতিক নৃত্য শিক্ষা সম্মেলন ২০১৮’–এ অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন নৃত্যশিল্পী পূজা সেনগুপ্ত। ঘুরে এসে লিখেছেন সেই অভিজ্ঞতা। 

চীন সরকারের ১৯তম জাতীয় সম্মেলনের ঘোষণার অংশ হিসেবে ২৭ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিল দুই দিনব্যাপী সম্মেলন। বেইজিং ডান্স একাডেমি, ক্যাপিটাল নরমাল বিশ্ববিদ্যালয় বেইজিং ও নর্থওয়েস্ট নরমাল বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত এই সম্মেলনে সারা বিশ্বের স্বনামধন্য নৃত্যশিল্পী ও নৃত্য প্রশিক্ষকেরা অংশগ্রহণ করেছেন। আমিও সেই অংশগ্রহণকারীদের একজন হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলাম। ২৬ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে উড়াল দিয়ে ডান হুয়াং পৌঁছেছি পরদিন স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে ৪টায়। সম্মেলন এবং আমাদের থাকার ব্যবস্থা; দুটোই ছিল সানসাইন হোটেল রিসোর্ট নামের একটি পাঁচতারা হোটেলে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৩৮টি বিশ্ববিদ্যালয় অংশগ্রহণ করেছিল সম্মেলনে। এই অল্প সময়ের মধ্যেই দারুণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে প্রায় সবার সঙ্গে। অধিকাংশই ইংরেজি ভাষাভাষী নয়। তবে তাতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। এটাই বোধ হয় শিল্পের অন্যতম প্রধান একটি শক্তি। ভৌগোলিক দূরত্ব, ভাষার ব্যবধান, সংস্কৃতির পার্থক্য; সবকিছুকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে একই সুতোয় যেন নিয়ে আসে শিল্পবোধ।

যাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন, সবাই শিল্পী। যখন আমার দেশের নাচ, নাচের বৈচিত্র্য নিয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলছি, ওরাও আগ্রহী হয়ে উঠেছে আমাদের দেশের শিল্পের সার্বিক দিক নিয়ে। হোটেলে বসে যখন আড্ডা দিচ্ছিলাম, আমার ল্যাপটপ থেকে নাচের বিভিন্ন ভিডিও দেখাচ্ছিলাম ওদের। আবার ওদের একেকজন নিজস্ব দেশীয় সংস্কৃতি তুলে ধরছিল। সংস্কৃতি বিনিময়ের এই অভিজ্ঞতাটি অত্যন্ত উপভোগ্য ছিল। যুক্তরাজ্য থেকে এসেছিল অ্যানি। ইংরেজিভাষী বলে ওর সঙ্গে দ্রুতই একটা দারুণ সম্পর্ক তৈরি হয়। ২৭ তারিখে ছিল আমার প্রবন্ধ উপস্থাপন। প্রবন্ধের শিরোনাম ‘প্রথাগত ও সৃজনশীল নৃত্য শিক্ষা পদ্ধতির সহাবস্থান’। সবাই অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে আমার উপস্থাপিত প্রবন্ধ শুনেছেন। চীনের একটা সুবিধা হচ্ছে, ওদের দেশে ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপের মতো মনোযোগ বিনষ্ট করার উপকরণ নেই। ফলে শুধু শারীরিকভাবে নয়, সর্বাত্মকভাবেই সবাই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

প্রবন্ধ উপস্থাপন শেষে বেইজিং ডান্স একাডেমির পরিচালক আলোচনার শুরুতেই আমার উপস্থাপিত প্রবন্ধ নিয়ে উৎসাহমূলক কতগুলো কথা বলেছিলেন। ‘এখন যাঁরা নৃত্য প্রশিক্ষণ দেন, তাঁদের ভেতর থেকে দর্শন হারিয়ে যাচ্ছে। তাঁরা শুধুই নাচ শেখান, তাতে দর্শনের সংযোগ নেই। যেকোনো শিল্পের জন্যই দর্শন থাকাটা জরুরি। আমার ভালো লাগছে এই দেখে যে তোমার শিল্পবোধে দর্শনটা খুব পরিষ্কার’—পরিচালকের এই বক্তব্যকে দোভাষী যখন তরজমা করে দিচ্ছিলেন, তখন প্রতিটা শব্দ যেন অনুপ্রেরণার মন্ত্র হয়ে আমার ভেতর প্রবেশ করছিল।

বিদেশ–বিভুঁইয়ে এলে সে দেশটা ঘুরেফিরে দেখাও শিল্প-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঘুরতে বের হলাম ২৮ তারিখে। লক্ষ করলাম, দারুণ শহর ডান হুয়াং। সাংস্কৃতিকভাবে খুবই সমৃদ্ধ। বিশ্বব্যাপী শহরটিকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে তুলে ধরতে চীন সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে। এখান থেকেই শুরু হয়েছে চীনের নিউ সিল্ক রোড; বিশ্বের সঙ্গে চীনের যোগাযোগ তৈরির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। নিউ সিল্ক রোডের ওপর নির্মিত একটি থিয়েটারও দেখানো হলো আমাদের। এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো মোগল গ্রুটোতে। এক হাজারটা গুহা, তাতে বুদ্ধমূর্তি, দেয়ালে খোদাই করা বিভিন্ন ধরনের শিল্পনিদর্শন। অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন সেই সব শিল্প।

২৯ সেপ্টেম্বর যখন ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, কী এক অদ্ভুত স্মৃতিকাতরতায় আক্রান্ত হলাম। ক্যাপিটাল নরমাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অধ্যাপক তিয়ান পেই পেই, রাশিয়ার ল্যুদমিলা, সিঙ্গাপুরের চুয়া সু পং, যুক্তরাজ্যের অ্যানি; অল্প সময়ে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব কোথায় যেন আঁকড়ে ধরছিল আমাকে। তবে শিল্প-সংস্কৃতি বিনিময়ের মাধ্যমে গড়ে ওঠা এই যোগাযোগ থাকবে অবিচ্ছিন্ন। বাংলাদেশ থেকে কেউ যদি সেই সব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বৃত্তি বা পড়াশোনার আবেদন করতে চায়, তুরঙ্গমীর মাধ্যমে তারা আবেদন করতে পারবে।